প্রাণীর সেবায় ‘রবিনহুড দ্য এনিমেল রেসকিউয়ার’

0
74
‘রবিনহুড দ্য এনিমেল রেসকিউয়ার
পোষা প্রাণী সুরক্ষায় ‘রবিনহুড দ্য এনিমেল রেসকিউয়ার’

‘রবিনহুড দ্য এনিমেল রেসকিউয়ার’ নামে সংগঠনটি দিন-রাত প্রাণীর কল্যাণ ও সুরক্ষায় কাজ করে। কোনো কুকুরকে কেউ পিটিয়ে আহত করেছে, ছুটে যায় রবিনহুডের স্বেচ্ছাসেবী দল। কোনো বিড়াল বহুতল ভবনের কার্নিশে আটকা পড়েছে, ডাক পড়ে তাদের। কারো পোষা প্রাণী হারিয়ে গেছে, খুঁজে আনতে নানা তৎপরতা চালায় এ সংগঠনের কর্মীরা।

কয়েক বছর ধরে জাতীয় জরুরি সেবা নম্বর ৯৯৯ এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে কাজ করছে রবিনহুড।

প্রাণীদের বিনা কারণে আহত করা, ইট ছুড়ে মারা, গরম তেল ঢেলে দেওয়া, চোখ উঠিয়ে ফেলা, ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করা, কখনো বিকৃত যৌনাচার যেন নিয়মিত বিষয়। দেড়-দুই দশক আগেও এ নিয়ে জনসচেতনতা ছিল না বললেই চলে। সরকারিভাবেও এ নিয়ে প্রচার কিংবা জনসচেতনতা কম।

প্রায় ১৩ বছর আগে প্রাণীদের কল্যাণ ও সুরক্ষায় এগিয়ে আসে ‘রবিনহুড দ্য এনিমেল রেসকিউয়ার’। ইতিমধ্যে দেশে ও বিদেশে ব্যাপক পরিচিতি পেয়েছে সংগঠনটি। কিন্তু আর্থিক সংকটে হিমশিত খাচ্ছেন এর সংশ্লিষ্টরা।

১০ বছরে ১ লাখ প্রাণীকে সেবা

রাজধানীর খিলগাঁওয়ের তিলপা পাড়ায় তাদের অফিসে কার্যক্রম ও নিয়ে কথা হয় এর প্রতিষ্‌ঠাতা ও সংগঠনের চেয়ারম্যান আফজাল খান বলেন, শুরু থেকে অলাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে তারা সেবা দিয়ে আসছেন। কিন্তু এখন আর কুলিয়ে উঠতে পারছেন না। সরকারি কোনো বরাদ্দ নেই। তার নিজের সঞ্চয়, কয়েকজন শুভাকাঙ্ক্ষীর অনুদান এবং ক্লিনিক থেকে প্রাপ্ত কিছু আয় দিয়ে কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছেন। কিন্তু এ অবস্থা কত দিন চরবে তা জানেন না তিনি।

তিনি জানান, প্রতিষ্ঠার পর গত ১০ বছরে অন্তত ১ লাখ কুকুর, বিড়াল, গরু, শজারু, বানর, বিভিন্ন প্রজাতির পাখিসহ হয় উদ্ধার করেছে নয়তো চিকিৎসা দিয়েছে সংগঠনটি। প্রতিটি দিনই ব্যস্ততা থাকে তাদের। অসহায় প্রাণীর জীবন বিপন্নতার খবর আসে প্রতিদিন। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসে কোনো না কোনো প্রাণীর সমস্যার খবর।

তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সংগঠনের অফিসকর্মী রয়েছেন ১৭ জন। তাদের বেতন দিতে হয়। এ ছাড়া স্বেচ্ছাসেবী আছেন আরো অন্তত ১৫ জন। তারা কোনো বেতন নেন না। কিন্তু কাজ করেন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। কোথাও কোনো প্রাণী আহত অবস্থা পড়ে আছে বা বহুতল ভবনের কোনো কার্নিশে আটকে আছে কোনো বিড়াল- মুহূর্তেই ছুটে আসেন কর্মীরা। কোনো প্রাণীর উদ্ধারের খবর পেলেই রেসকিউ টিমের গাড়ি ও অ্যাম্বুলেন্সের জন্য প্রতিদিন গড়ে সাড়ে চার হাজার থেকে ৫ হাজার টাকা খরচ হয়।

আফজাল খান বলেন, অফিসে পর্যাপ্ত জায়গা হচ্ছে না। এ জন্য প্রয়োজন বড় পরিসরে একটি জায়গা, যেখানে প্রাণীদের রাখা যাবে সুরক্ষায়। এক সময় অসহায় বা আহত প্রাণীকে নিজের খরচে উদ্ধার কিংবা চিকিৎসার ব্যবস্থার করলেও এখন সেটি হয়ে উঠছে না।

তিনি বলেন, সম্প্রতি এ নিয়ে সংগঠনের ফেসবুক থেকে এ ধরনের বিপদগ্রস্ত বা আহত প্রাণীকে উদ্ধার কিংবা চিকিৎসার বিষয়ে যারা আগ্রহী এবং খরচ দিতে পারেন, তাদের যোগযোগ করতে বলা হয়েছে।

অফিস ঘুরে দেখা যায়, কম-বেশি অসুস্থ কিংবা আহত অন্তত ১০৬টি কুকুর ও বিড়াল রয়েছে ক্লিনিকে। বেশির ভাগ প্রাণী কোন না কোনোভাবে অসুস্থ কিংবা বয়স্ক। এর মধ্যে কোনাটির চোখ নেই, কোনটা পক্ষাঘাতগ্রস্ত বা প্যারালাইজড। এদের প্রতিদিনের খাবার, চিকিৎসা ওষুধ সব খরচ বহন করতে হচ্ছে সংগঠনটিকে। স্থানের অভাবে তাদের ঠিকমতো পরিচর্যা করতে পারছেন না কর্মীরা। অসহায় প্রাণীদের জন্য নিজেদের একটি ফ্ল্যাট ছেড়ে দিয়েছেন সংগঠনের চেয়ারম্যান।

প্রতিদিন এই প্রাণীগুলোর জন্য বরাদ্দ রয়েছে ১৪ কেজি মুরগির মাংসসহ অন্যান্য খাবার। প্রতি মাসে তাদের জন্য বরাদ্দ করতে হয় অন্তত ৪০০ কেজি মাংস। এ ছাড়া চিকিৎসা ও ওষুধ খরচ তো আছেই।

মুহূর্তে ভালো হয়ে উঠছে প্রাণীরা

‘কেয়ার অ্যানিমেল ক্লিনিক’ নামে ছোট পরিসরে সংগঠনের একটি নিজস্ব ক্লিনিক রয়েছে একই ঠিকানায়। কার্যালয়ে বসে এ প্রতিবেদক যখন কথা বলছিলেন তখন বেলা সাড়ে ১১টার দিকে মুন্নী আক্তার ও তার ভাই রাব্বী আসেন একটি বিড়াল নিয়ে।

কথা প্রসঙ্গে বলেন, সিপাহিবাগ আদর্শ গলির বাসিন্দা তারা। সকালে ‘কিটি’ নামের বিড়ালটি অসাবধানতাবশত তেলাপোকা মারার ওষুধ খেয়ে ফেলে। এরপর থেকেই ক্রমাগত বমি করছে অসহায় প্রাণীটি। একজনের কাছ থেকে মোবাইল নম্বর ও ঠিকানা নিয়ে দ্রুত চলে আসেন এখানে। মাত্র ১০ মিনিটরে মধ্যে বিড়ালটিকে সুস্থ করে তোলেন এখানকার কর্মীরা।

মুন্নী আক্তার বলেন, ‘খুব প্রিয় বিড়ালটি। ভেবেছিলাম ওকে আর হয়তো ফিরে পাব না। কিন্তু সামান্য অর্থে তাদের আন্তরিকতায় কিটি সুস্থ হয়ে উঠেছে।’

একটু পরেই ‘সিম্বা’ নামে একটি বিড়াল নিয়ে আসেন মো. লিটন মিয়া। ফকিরাপুলের আবাসিক হোটেলের ব্যবসা রয়েছে তার। বাস করেন সেখানেই। প্লাস্টিকের ঝুড়িতে থাকা বিড়ালটি দেখিয়ে বলেন, বিদেশি প্রজাতির বিড়ালটি কিনেছিলেন কাঁটাবন থেকে। মঙ্গলবার থেকে হঠাৎই খাওয়া বন্ধ করে দেয় বিড়ালটি। সঙ্গে পাতলা পায়খানা। ধীরে ধীরে ঝিমিয়ে পড়তে থাকে। সরকারি প্রাণী হাসপাতালে নিয়ে সেখানকার চিকিৎসায় আস্থা রাখতে পারেননি। এরপর নিয়ে আসেন এখানে।

লিটন মিয়া বলেন, ‘সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসক থাকে না সসসময়। পর্যাপ্ত ওষুধও নেই। ভরসা পাচ্ছিলাম না। তাই এখানে আসা। তাদের আন্তরিকতায় আমার প্রিয় প্রাণীটি সুস্থ হয়ে উঠেছে।’

সংশ্লিষ্টরা জানান, নিয়মিত পশু চিকিৎসক আসেন এখানে। যেকোনো প্রাণীর ছোট থেকে বড় জটিল অস্ত্রোপচারও হয় সফলতার সঙ্গে। কুকুর, বিড়ালসহ প্রায় সব প্রজাতির পাখি, গবাদিপশু, প্রাণীদের ভ্যাকসিন, নিউটার, স্প্রে, অক্সিজেন সুবিধা, লেজার থেরাপি, কেমো থেরাপি, ইকো থেরাপি, ফ্লু টেস্ট আল্ট্রাসনোগ্রাম, এক্স রে, নেবুলাইজার, প্রাণীদের ওষুধ, এক্সেসরিজ পাওয়া যায় ক্লিনিকে। এ জন্য নির্ধারিত হারে কিছু খরচ দিতে হয়।

সংকট কাটবে কবে

আফজাল খান বলেন, ‘সবকিছুরই দাম বেড়েছে। এখন চাইলেও ওষুধ ও যন্ত্র কিনতে পারি না। অসহায় প্রাণীর চিকিৎসা বা সরকারি সহযোগিতা না পেলে এই সেবার পরিসর কমিয়ে আনতে হবে।’

তিনি বলেন, ‘নানা প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও আমাদের কার্যক্রম থেমে নেই। কিন্তু এখন আসলেই কুলিয়ে উঠতে পারছি না। প্রাণীদের বিষয়ে আমাদের চিন্তাভাবনার পরিধি ব্যাপক। কেন না দেশে প্রাণীদের ওপর নিষ্ঠুরতা দিনকে দিন বাড়ছে। সংগঠনের কার্যক্রম হয়তো চলছে কিন্তু এভাবে চালানো সত্যিই মুশকিল।’

মৎস্য ও প্রাণী সম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম বলেন, ‘অসহায় প্রাণীদের সহায়তা করে এমন বেসরকারি সংগঠনগুলো প্রতি আমাদের নজর রয়েছে। কিন্তু করোনা পরিস্থিতি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে পরিস্থিতিতে বৈশ্বিক আর্থিক সংকটসহ এসব নানা কারণে এই মুহূর্তে তাদের সরকারিভাবে প্রণোদনা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে অবশ্যই বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে তাদের সহযোগিতা করা হবে।’