বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে বিভিন্ন সংক্রামক রোগ ও মানসিক স্বাস্থ্যের সম্পৃক্ততা উঠে আসছে। বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক প্রতিবেদন ‘ক্লাইমেট অ্যাফ্লিকশন’-এর মধ্যে দেখা যায়, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশে শ্বাসযন্ত্রের রোগ এবং মশার কামড়জনিত রোগসহ নানা মানসিক রোগের মাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
২০১৯ সালে ঢাকায় ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাবের কথাই ধরা যাক। সেবার দেশে মোট ডেঙ্গুতে মৃত্যুর ৭৭ শতাংশই ছিল ঢাকায়। এ মৃত্যুর পেছনে রাজধানীর অস্থিতিশীল আবহাওয়ার সরাসরি ভূমিকা রয়েছে। ওই বছর ঢাকায় ফেব্রুয়ারিতে বৃষ্টিপাতের মাত্রা ছিল ১১৫ মিলিমিটার, যা ১৯৭৬ সালের পর থেকে ঢাকায় সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত। মার্চ থেকে জুলাইয়ের মধ্যে গ্রীষ্মকালে তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা ছিল অনেক বেশি, যা মশার বংশবিস্তারের জন্য আদর্শ পরিবেশ তৈরি করেছে।
১৯৭৬ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে বাংলাদেশের তাপমাত্রা বেড়েছে ০ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। মাসিক তাপমাত্রার ডেটা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, সাম্প্রতিক সময়ে এদেশে গ্রীষ্মকাল অনেক বেশি দীর্ঘতর ও উষ্ণতর হচ্ছে এবং শীতকাল আরও উষ্ণতর হয়ে উঠছে। এদিকে বর্ষাকাল মার্চ থেকে ধরে অক্টোবর পর্যন্ত স্থায়ী হচ্ছে। ষড়ঋতুর দেশ হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশের ঋতুবৈচিত্র ধীরে ধীরে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
ঢাকার আবহাওয়া সংক্রান্ত ডেটা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এখানে আর্দ্রতার মাত্রা কমে আসছে, তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং গ্রীষ্মকালে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ক্রমশ বাড়ছে। এ ধরনের জলবায়ু পরিবর্তনের পাশাপাশি নগরায়ন, ভ্রমণ এবং জনসংখ্যা-সংক্রান্ত পরিবর্তনের ফলে মশার উপদ্রব বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং ভবিষ্যতে ঢাকায় ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাবের ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলছে।
বাংলাদেশ থেকে প্রাপ্ত নতুন প্রমাণের ভিত্তিতে বলা যায়, আবহাওয়া মানুষের উদ্বিগ্নতা ও বিষাদগ্রস্ততাকে প্রভাবিত করে। উদাহরণস্বরূপ, গ্রীষ্মকালে মানুষ বর্ষাকালের চাইতে কম দুশ্চিন্তাগ্রস্ত থাকে। তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা বাড়ার সাথে সাথে উদ্বিগ্নতাও বেড়ে যায়। এছাড়া পুরুষদের চাইতে নারীরা বেশি হতাশায় ভোগেন; অন্যদিকে, পুরুষেরা উদ্বিগ্নতার শিকার হন বেশি।
শুধু লিঙ্গভেদেই নয়, ভৌগলিক অবস্থানভেদেও মানসিক স্বাস্থ্যের হেরফের হয়। ঢাকা ও চট্টগ্রামে হতাশা ও উদ্বিগ্নতার শিকার হওয়া মানুষের সংখ্যা যথাক্রমে ১৬ শতাংশ এবং ৩১ শতাংশ, যা জাতীয় গড় মাত্রার চাইতে বেশি। তাই জলবায়ু পরিবর্তন যত জোরদার হবে, আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যের উপরে তত বেশি খারাপ প্রভাব পড়বে।
জলবায়ু পরিবর্তন কোনো ভবিষ্যত সমস্যা নয়, এটি ইতোমধ্যেই বাংলাদেশে অনুভূত হচ্ছে। জলবায়ু যত বেশি পরিবর্তিত হবে, তত বেশি শারীরিক ও মানসিক সমস্যা দেখা দিবে। মানসিক স্বাস্থ্যকে এখানে প্রায়ই উষ্মার চোখে দেখা হয় এবং এড়িয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু সমস্যার যথাযথ মূল্যায়ন ও সমাধানের উদ্যোগ নেওয়ার মাধ্যমে মানসিক স্বাস্থ্যের ইস্যুটিকে মূলধারায় নিয়ে আসা প্রয়োজন।
এক্ষেত্রে প্রতিরোধ ও প্রতিকার, দুটিই আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত। অক্ষম ও বয়স্ক ব্যক্তিদের মতো সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ও দুর্বল অবস্থানে যারা আছে, তাদেরকে আগে গুরুত্ব দিতে হবে। যেহেতু মানসিক স্বাস্থ্যের ইস্যুতে নারী ও পুরুষ ভিন্ন ভিন্নভাবে প্রতিক্রিয়া দেখায়, তাই তাদের প্রতি জেন্ডার-সংবেদনশীল আচরণ করা খুবই জরুরি।
জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার এখনই সময়, আর দেরি করা যাবেনা আমাদের। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবগুলোর সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়ার জন্য এখন থেকেই পর্যাপ্ত সাড়াদান প্রক্রিয়া নিশ্চিত করতে হবে। একই সাথে জলবায়ু-সংবেদনশীল রোগগুলোর বিবর্তনের দিকে নজর রাখাও সমান গুরুত্বপূর্ণ। স্থানীয় আবহাওয়া সংবাদ ও তথ্যাদি ব্যবহার করা এবং রোগের সংক্রমণের দিকে নজর রাখার মাধ্যমে এই কাজ করা সম্ভব।
তবে এর জন্য বাংলাদেশকে স্থানীয় ও প্রাথমিক পর্যায় থেকে আবহাওয়া-সংক্রান্ত ডেটা নির্ভুলভাবে নিরুপণ করতে হবে এবং সেটিকে স্বাস্থ্য-সংক্রান্ত ডেটার সাথে সংযুক্ত করতে হবে। আবহাওয়া ডেটা মূল্যায়নের মাধ্যমে রোগের সম্ভাব্য প্রাদুর্ভাব নির্ণয় করা যায়। রোগের উপর নজরদারি বৃদ্ধি এবং জলবায়ুভিত্তিক ডেঙ্গু সতর্কতা প্রক্রিয়া জারির মাধ্যমে আরও ভালোভাবে নিজেদের প্রস্তুত রাখতে পারে বাংলাদেশ। বাংলাদেশকে একটি শক্তিশালী স্বাস্থ্য ব্যবস্থাও তৈরি করতে হবে যাতে তারা জলবায়ু-সংবেদনশীল রোগের প্রাদুর্ভাবকে মোকাবিলা করতে পারে।
অদ্বিতীয় ভৌগলিক অবস্থান এবং একটি নিচু ব-দ্বীপ হওয়ার কারণে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সবচেয়ে ঝুঁকির মুখে থাকা দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ একটি। দক্ষিণে সমুদ্র উপকূলবর্তী অঞ্চলে বসবাসরত মানুষ থেকে ধরে উত্তরে, এমনকি রাজধানী ঢাকাবাসীও জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে মুক্ত নয়। জলবায়ু পরিবর্তন মানে শুধুমাত্র বন্যা বা সাইক্লোন নয়। এটি আমাদের আবহাওয়ার গঠনকে বদলে দিচ্ছে।