রোজায় স্বাস্থ্যের উন্নতি হয়, বলছেন চিকিৎসকরা

0
89

পবিত্র রমজান মাসে মুসলমানরা প্রতিদিন সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত খাওয়া-দাওয়া করে না। ইসলামে রোজা হচ্ছে এমন একটি ইবাদত যা ব্যক্তির আধ্যাত্মিক উন্নতির পাশাপাশি সৃষ্টিকর্তার সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ককে আরও বাড়িয়ে দেয়।

একইসঙ্গে আত্ম-নিয়ন্ত্রণ ও সংযম অনুশীলন করার এবং যাদের প্রয়োজন তাদের প্রতি সহানুভূতি দেখানোর একটি উপায়ও হচ্ছে রোজা। এছাড়া প্রতিদিন সূর্য অস্ত যাওয়ার সাথে সাথে ইফতার করাটা আসলে কৃতজ্ঞতা, প্রতিফলন এবং ঐক্যের মুহূর্ত হয়ে ওঠে।

আত্ম-শৃঙ্খলার এই কাজটি কেবল আত্মাকে পরিষ্কার করার এবং সৃষ্টিকর্তার সাথে সংযোগকে শক্তিশালী করার উপায় হিসাবে কাজ করে না, এটি শরীরের ওপরও গভীর প্রভাব ফেলে। গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি, কার্ডিওলজি এবং এন্ডোক্রিনোলজি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রমজান মাসে রোজা রাখা শারীরিক স্বাস্থ্যকে ইতিবাচকভাবে প্রভাবিত করতে পারে।

রোজা রাখা মানবদেহের হজমের উন্নতি, বিপাক বৃদ্ধি এবং ওজন কমানোর জন্য উপকারী। এছাড়া রোজা শরীরকে ডিটক্সিফাই এবং পুনরুজ্জীবিত করে। যার ফলে মানব শরীর নতুন জীবনীশক্তি লাভ করে।

গ্যাস্ট্রোএন্টেরোলজিস্টরা উল্লেখ করেছেন, নিত্য বা প্রত্যাহিক হজম প্রক্রিয়া থেকে বিরতি দেওয়ার কারণে রোজা মানবদেহের সুস্থ হজমসংক্রান্ত প্রক্রিয়াকে আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে। এর ফলে এটি নিজেকে নিরাময় এবং নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।

রমজানের সময় খেজুর দিয়ে ইফতার করা ইসলামী রীতিনীতির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ এবং এটি আধ্যাত্মিকভাবেও গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়, যেমনটি মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) করতেন।

কার্বোহাইড্রেট, ফাইবার, চিনি, ম্যাগনেসিয়াম এবং পটাসিয়াম-সহ পুষ্টির একটি ভালো উৎস হচ্ছে খেজুর। খেজুর খাওয়ার ফলে রক্তে শর্করার মাত্রা দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং খেজুরে প্রচুর পরিমাণে কার্বোহাইড্রেট শারীরিক সতেজ অনুভব করতে সাহায্য করে।

ক্লিভল্যান্ড ক্লিনিক হাসপাতালের মতে, বেশিরভাগ গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল রোগ এবং অবস্থা চিকিৎসা বা প্রতিরোধ করা যেতে পারে। এর মধ্যে রয়েছে ইরিটেবল বাওয়েল সিনড্রোম যা ফোলাভাব, বেদনাদায়ক পেট ব্যথা, কোষ্ঠকাঠিন্য এবং কখনও কখনও ডায়রিয়ার কারণ হয়। অন্যান্য উদাহরণ হলো- গলস্টোন, প্যানক্রিয়াটাইটিস, হেপাটাইটিস এবং ম্যালাবসর্পশন সিন্ড্রোম।

ডা. আদিব আল-গালেইনি আরব নিউজকে বলেছেন, দীর্ঘস্থায়ী সমস্যায় ভুগছেন বা যারা তাদের অন্ত্রের স্বাস্থ্য ভালো রাখতে চান তাদের জন্য এক মাসের রোজা রাখা গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল সিস্টেমের ওপর অসাধারণ প্রভাব ফেলে।

আদিব আল-গালেইনি হলেন গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি এবং এন্ডোস্কোপি ইউনিটের প্রধান, গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি এবং থেরাপিউটিক এন্ডোস্কোপির একজন কনসালট্যান্ট এবং জেদ্দার ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল সেন্টার বা আইএমসির ফেলোশিপ প্রোগ্রাম ডিরেক্টর।

তিনি বলেন, রমজানে রোজা রাখার সুফল পেতে হলে মানুষকে স্বাস্থ্যকর, পরিষ্কার ও হালকা খাদ্যাভ্যাস মেনে চলতে হবে। আর তেমনটি করা হলে সেটি শরীরকে ডিটক্সিফাই করতে এবং বছরের পর বছর ধরে গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল সিস্টেমে জমে থাকা ব্যাকটেরিয়া এবং ভাইরাসগুলোর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে দেয়।

অন্যদিকে কার্ডিওলজিস্টরা দেখেছেন, রোজা মানুষের হৃদযন্ত্রের স্বাস্থ্যের উন্নতি করতে পারে। ডা. সেরাজ আবুলনাজা বলছেন, ‘রোজা কার্ডিওভাসকুলার ঝুঁকির কারণগুলোর ওপর বেশ কিছু ইতিবাচক প্রভাব ফেলে, যেমন রক্তচাপ কমানো, কোলেস্টেরলের মাত্রা কমানো, ইনসুলিনের সংবেদনশীলতা উন্নত করা এবং ওজন কমানোর কাজ। আর এটি ভবিষ্যতে হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোকের মতো কার্ডিয়াক অসুস্থতার ঝুঁকিও হ্রাস করতে পারে।

সেরাজ আবুলনাজা ইন্টারভেনশনাল কার্ডিওলজিস্ট ও একজন কনসালট্যান্ট এবং জেদ্দার আইএমসির কার্ডিয়াক সেন্টারের প্রধান।

আবুলনাজা বলছেন, ‘রোজা রাখা উপকারী হলেও হৃদরোগ সংক্রান্ত সমস্যায় থাকা ব্যক্তিদের তাদের স্বাস্থ্যের অবস্থা মূল্যায়ন করতে এবং সেই অনুযায়ী ব্যক্তিগতভাবে সুপারিশ নিতে রমজানে রোজা রাখার আগে চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করা উচিত।’

এন্ডোক্রিনোলজিস্টরাও দেখেছেন, রোজা রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে এবং ইনসুলিন সংবেদনশীলতা উন্নত করতে সাহায্য করে, যা ডায়াবেটিস বা রোগের ঝুঁকিতে থাকা ব্যক্তিদের জন্য উপকারী।

জেদ্দার দ্য ফার্স্ট ক্লিনিকের এন্ডোক্রিনোলজি, মেটাবলিক ডিজিজ এবং ইন্টারনাল মেডিসিনের কনসালট্যান্ট ডক্টর আহমেদ বাসাঈদ বলছেন: ‘রোজা রক্তে শর্করার মাত্রা উন্নত করে, বিশেষ করে ডায়াবেটিস টাইপ ২ রোগীদের জন্য, কারণ রোজা রাখার মাধ্যমে আমরা খাদ্য গ্রহণের পরিমাণ কমিয়ে দেই। দিনের বেলা খেতে দেওয়া হয় না।’

বাসাঈদ বলেন, ডায়াবেটিক রোগে আক্রান্ত নয় এমন ব্যক্তিদের যাদের ওজন বেশি বা স্থূল তাদের ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি বেশি। তিনি বলছেন, ‘রোজা ক্যালোরি, শর্করা, সোডা ড্রিঙ্কস এবং স্টার্চ হ্রাস করে একটি স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন করতে সাহায্য করে, আর এই পদ্ধতিতেই শরীরের ওজন কমায় রোজা।’

তিনি আরও বলেন, উচ্চ-গ্লাইসেমিক রয়েছে এমন খাবার যেমন সাদা রুটি, মিষ্টি এবং পাস্তা খাওয়া এড়িয়ে চলা উচিত, কারণ এসব খাবার দ্রুত রক্তে শর্করা এবং খারাপ কোলেস্টেরল বাড়ায়।

বাসাঈদ বলেন, অল্প সময়ে ও দ্রুততার সঙ্গে প্রচুর পরিমাণে খাবার গ্রহণ করাও এড়ানো গুরুত্বপূর্ণ। প্রোটিন গ্রহণ বৃদ্ধির পাশাপাশি সুষম খাদ্য গ্রহণের দিকে মনোযোগ দেওয়া উচিত।

তিনি বলেন, ‘ডায়াবেটিক রোগীদের তাদের রক্তে শর্করার পরিমাণ আরও ঘন ঘন পরিমাপ করা উচিত, বিশেষ করে রোগীদের ইনসুলিন বা ওষুধ হাইপোগ্লাইসেমিয়া বা রক্তে কম শর্করার ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।’

যদি রক্তে শর্করার মাত্রা কম হয় — প্রতি ডেসিলিটারে ৭০ মিলিগ্রাম বা তার নিচে — তাহলে ডায়াবেটিক রোগীদের অবিলম্বে তাদের রোজা ভাঙতে হবে বলেও বাসাঈদ জানান।

চিকিৎসকরা একমত, রোজার সুফল পেতে হলে এবং অবাঞ্ছিত প্রভাব এড়াতে হলে এই সময়টাতে প্রধানত সুষম খাদ্য গ্রহণের দিকে মনোযোগ দিতে হবে। বদহজম বা কোষ্ঠকাঠিন্য এড়াতে প্রচুর পরিমাণে পানি পান করা এবং ফাইবারযুক্ত খাবারের পরিমাণ বৃদ্ধি করাও অপরিহার্য।

আবুলনাজা বলেন, ‘রমজানে নিয়মিত ব্যায়াম করা এবং ধূমপান থেকে বিরত থাকাও গুরুত্বপূর্ণ।’

সূত্র: আরব নিউজ