এখনো মানুষের কঙ্কালে আটকে আছে হাজার বছর আগের ব্যাকটেরিয়া-ভাইরাস। এগুলো থেকে নতুন কী তথ্য পাওয়া যেতে পারে, তা খুঁজে বের করার চেষ্টা করছেন বিজ্ঞানীরা।
বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ১৬ শতকে বর্তমান মেক্সিকোতে হঠাৎ করেই জনসংখ্যা অত্যন্ত হ্রাস পায়। ইউরোপীয়রা অঞ্চলটি দখল করার পর সেখানে রোগ ছড়িয়ে পড়ে আর লাখো আদিবাসী মারা যায়। সবাই ধারণা করতো ইউরোপীয়রা রোগটি নিয়ে এসেছিল, তবে এর জন্য কোন জীবাণু দায়ী ছিল তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। বর্তমান সময়ে বিজ্ঞানীদের একটি দল সেই সময়ের ব্যক্তিদের দাঁত থেকে প্রাচীন ভাইরাল ডিএনএ বের করেছে। এই কঙ্কালগুলো নিউ মেক্সিকোতে ঔপনিবেশিক যুগের হাসপাতাল এবং গির্জার নিচে সমাহিত ছিল।
ডিএনএ পরীক্ষায় দেখা গেছে, আক্রান্তরা হেপাটাইটিস বি ভাইরাস এবং হিউম্যান বি ১৯ ভাইরাসে সংক্রমিত হয়েছিল, যাতে মূলত প্রাণীরা আক্রান্ত হয়। ইউরোপ থেকে নয়, বরং ভাইরাসগুলো সম্ভবত আফ্রিকা থেকে উদ্ভূত হয়েছিল।
এ বিষয়ে ইউনিভার্সিডাড ন্যাসিওনাল অটোনোমা ডি মেক্সিকোর ইন্টারন্যাশনাল ল্যাবরেটরি ফর হিউম্যান জিনোম রিসার্চের সহকারী অধ্যাপক মারিয়া সি আভিলা আরকোস বলেন, ভাইরাসগুলোর উৎস আফ্রিকান বলে মনে হচ্ছে। যে তিনটি দেহ বিশ্লেষণ করছি তারাও জিনগতভাবে আফ্রিকান ছিল।
তিনি আরও জানান, সেই সময়ে ইউরোপীয় ব্যবসায়ী এবং উপনিবেশবাদীরা আফ্রিকানদের জোরপূর্বক দাস বানিয়ে হাজার হাজার মাইল দূরের আমেরিকা মহাদেশে নিয়ে গিয়েছিল। জাহাজের মানবেতর অবস্থার কারণে সংক্রমণ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। এমনকি তাদের অপহরণ করে অমানবিক অবস্থায় ঠাসাঠাসি করে অস্বাস্থ্যকর জাহাজে নেওয়া হয়েছিল।
আভিলা আরকোস বলেন, আমেরিকার আদিবাসীরা এর আগে কখনও এই ভাইরাসের সংস্পর্শে আসেনি। ফলে এর সংক্রমণে তারা ঝুঁকিতে পড়ে। এটি আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বড় একটি অংশকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়।
জানা যায়, শতাব্দী পুরনো কঙ্কাল থেকে ডিএনএর মাধ্যমে প্রাচীন যুগের রোগের কারণ অনুসন্ধান নিয়ে কাজের ক্ষেত্র প্যালিওমাইক্রোবায়োলজির জগতে এক নতুন আবিষ্কার। এই ডিএনএ পুনর্গঠন করে বিজ্ঞানীরা ব্যক্তির মৃত্যুর শত শত বা হাজার বছর পরও একটি রোগ বা অবস্থা নির্ণয় করতে পারেন।
গুটিবসন্তের কথাই ধরা যাক। এই বিধ্বংসী রোগে কেবল ২০ শতকেই আনুমানিক ৩০ কোটি মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। তবে গুটিবসন্ত সৃষ্টি করা ভ্যারিওলা ভাইরাসের উৎপত্তির বিষয়টি সবসময়ই অস্পষ্ট ছিল। কিন্তু লিথুয়ানিয়ান একটি মমি থেকে প্রাপ্ত ডিএনএতে দেখা গেছে- এতে আক্রান্ত হওয়া সবচেয়ে পুরনো ঘটনাটি ছিল ১৭ শতকের।
তবে ২০২০ সালে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের বারবারা মুহলেমান নামের একজন পিএইচডি শিক্ষার্থী এবং তার সহকর্মীরা ৬০০ খ্রিস্টাব্দের ভাইকিং কঙ্কালের দাঁত থেকে ভেরিওলা ভাইরাস বের করার পর সময়টি আরও পিছিয়ে ধরা হয়।
এ প্রসঙ্গে বিবিসির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ডেনমার্ক, নরওয়ে, রাশিয়া এবং যুক্তরাজ্যের ১১টি সমাধিস্থল থেকে পাওয়া কঙ্কাল নিয়ে গবেষণা করা হয়েছিল। সুইডেনের পূর্ব উপকূলের ওল্যান্ড নামের একটি দ্বীপের একাধিক কঙ্কালেও গুটিবসন্ত পাওয়া গেছে। এতে দেখা গেছে গুটিবসন্তের প্রথম নিশ্চিত হওয়ার ঘটনাটি এক হাজার বছর আগের।
এদিকে ১০১টি কঙ্কালের দাঁত থেকে মাইক্রোবিয়াল ডিএনএ নিয়ে ২০১৫ সালে এক গবেষণায় করা হয়। এতে দেখা যায়, প্লেগ সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়া ওয়াই.পেস্টিস প্রথম নথিভুক্ত প্লেগ মহামারীর অন্তত তিন হাজার বছর আগে মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছিল। গবেষকরা সাতটি কঙ্কালের ডিএনএতে ওয়াই.পেস্টিস ব্যাকটেরিয়া খুঁজে পেয়েছেন, যার মধ্যে সবচেয়ে পুরনো জন মারা গেছে ৫ হাজার ৭৮৩ বছর আগে। যদিও আধুনিক প্লেগ সাধারণত সংক্রামিত মাছি বহনকারী ইঁদুরের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।
গবেষণায় দেখা গেছে, খ্রিস্টপূর্ব এক হাজার অব্দ পর্যন্ত প্লেগ ব্যাকটেরিয়া মাছিকে সংক্রমিত করার জন্য প্রয়োজনীয় মিউটেশন অর্জন করেনি।
বিবিসি বাংলা আরও জানিয়েছে, প্রাচীন মাইক্রোবিয়াল ডিএনএর জন্য এক দুর্দান্ত জায়গা হল দাঁতের গোঁড়ায় জমে থাকা ক্ষুদ্র কণা বা ফলক। সঠিকভাবে ব্রাশ না করলে এই আঠালো অংশটি দাঁতের উপর ব্যাকটেরিয়া তৈরি করে দাঁতের ক্ষয় এবং মাড়ির রোগ সৃষ্টি করে। অবশেষে একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এটি শক্ত হয়ে মুখের মধ্যে থাকা প্রাচীন ব্যাকটেরিয়া এবং ভাইরাসের ডিএনএকে ভেতরে আটকে রাখে। এই মাইক্রোবিয়াল জিনোম ডিকোডিং বিজ্ঞানীদেরকে হাজার বছর আগের রোগ সম্পর্কে জানার সুযোগ করে দিচ্ছে।
রোমের স্যাপিয়েঞ্জা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইমানুয়েলা ক্রিস্টিয়ানির নেতৃত্বে একটি দল ইংল্যান্ডের পিটারবোরোতে সেন্ট লিওনার্ডস এবং ফ্রান্সের সেন্ট-থমাস ডি’আইজিয়ারের মধ্যযুগীয় সমাধিস্থল থেকে খনন করা দাঁতের পাথরি পরীক্ষা করেছে। দলটি কিছু কঙ্কালে আদার চিহ্ন খুঁজে পেয়েছে যা থেকে বোঝা যায় এটি দিয়ে দাঁতের রোগ চিকিৎসার চেষ্টা করা হয়েছিল।
১১ শতকের একজন বিখ্যাত চিকিৎসক কনস্টানটাইন দ্য আফ্রিকান কুষ্ঠরোগের কারণে হওয়া পেটের ব্যথা উপশমে আদা এবং অন্যান্য মুখে খাওয়ার ভেষজ চিকিৎসা প্রস্তুত করার বিষয়ে লিখে গেছেন। কিছু রোগীর মধ্যে পারদও পাওয়া গেছে, যা ত্বকের সমস্যা ঢেকে রাখতে এবং ব্যথা উপশমকারী মলম হিসেবে ব্যবহার করা হতো। এর থেকে এটিও বোঝা যায় যে ভুক্তভোগীদের কেবল বিচ্ছিন্ন রাখার পরিবর্তে তাদের যত্নও নেওয়া হতো।
বিবিসির প্রতিবেদনে আরও দাবি করা হয়, দাঁতের ডিএনএ সিকুয়েন্সের মাধ্যমে একজন ব্যক্তি মারা যাওয়ার সময় তার কী কী সংক্রামক রোগ হয়েছিল সেটা ছাড়াও আরও অনেক কিছু বলা সম্ভব। ভবিষ্যতে এই প্রযুক্তি একজন ব্যক্তির মুখের মাইক্রোবায়োম অর্থাৎ মুখের ভেতর ও চারপাশে থাকা ব্যাকটেরিয়া ও ছত্রাকের বিশাল এবং বৈচিত্র্যময় ঝাঁক কেমন ছিল তা প্রকাশ করতে পারে। এই তথ্য আবার প্রাচীনকালে অসংক্রামক রোগ বা এনসিডি’র ব্যাপকতা সম্পর্কে আমাদের জানাতে পারে।
এনসিডি হলো একটি দীর্ঘস্থায়ী অবস্থা যা কেবল একটি নির্দিষ্ট সংক্রমণের ফলে হয় না। এগুলোর মধ্যে রয়েছে হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস এবং আলঝেইমার।
এ বিষয়ে পেনসিলভানিয়া স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের জৈবিক নৃবিজ্ঞানী অ্যাবিগেল গ্যাঙ্কজ বলেন, কয়েক দশক আগের গবেষণায় দেখা গেছে- কীভাবে মৌখিক স্বাস্থ্য এবং মাইক্রোবায়োম এই অবস্থাগুলোর সাথে সম্পর্কিত। প্রাচীন মিশরীয় সাহিত্যের লিখিত বর্ণনার সঙ্গে ডায়াবেটিসের মিল পাওয়া যায়, যেমন- প্রস্রাবের মিষ্টি-গন্ধের বিবরণ। অনুমান করা হয় অতীতে মানুষদের জীবন ছিল সংক্ষিপ্ত ও নৃশংস, তবে তাদের মধ্যে অনেকেই বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত বেঁচে ছিল এবং এই অসংক্রামক রোগগুলোতে আক্রান্ত হয়েছে।