দেশে এ বছর ভয়বাহ আকার ধারণ করছে মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গু জ্বর। প্রায় প্রতিদিনই পাল্লা দিয়ে বাড়ছে আক্রান্ত রোগী ও মৃতের সংখ্যা। অন্যান্য বছরের তুলনায় চলতি বছর নানা ধরনের পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে ডেঙ্গুর জীবানুবাহী এডিস মশা এবং ডেঙ্গুজ্বরের উপসর্গেও।
বাংলাদেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ আগের সব রেকর্ড ছাড়িয়েছে, মৃত্যুর সংখ্যা পার করেছে হাজারের ঘর। এমন অবস্থায় সাধারণ মানুষের মনে জাগছে নানা রকম প্রশ্ন। এমনই কিছু প্রশ্নের উত্তর দিয়েছে যুক্তরাজ্যভিত্তক সংবাদমাধ্যম বিবিসি বাংলা। যা দেয়া হল এখানে,
এডিস মশা কামড়ানোর কতদিন পর জ্বর আসে?
ডেঙ্গু জ্বরের জীবাণু বহনকারী মশার নাম এডিস এজিপ্টি যা আমাদের দেশে ডেঙ্গু মশা নামেই বেশি পরিচিত।
এডিস মশা কামড়ানোর কারণেই ডেঙ্গু জ্বর হয়। যদিও এই মশা কামড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে জ্বর হয় না।
রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ভাইরোলজি বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা সাবেরা গুলনাহার বলেন, ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হবার পর থেকে লক্ষ্মণ দেখা দিতে পাঁচ থেকে সাত দিন সময় লাগে।
এই সময়কে বলা হয় ইনকিউবেশন পিরিয়ড।
সাধারণত এডিস মশা কামড়ানোর পাঁচ থেকে সাত দিন মধ্যে আক্রান্ত ব্যক্তির জ্বর আসে। আর এই জ্বর থাকে পাঁচ থেকে ছয় দিন পর্যন্ত।
আক্রান্ত ব্যক্তি কতদিন ডেঙ্গু ছড়াতে পারে?
চিকিৎসকদের মতে, ডেঙ্গু ভাইরাসের চার রকম সেরোটাইপ পাওয়া যায়। এগুলো হলো- ডেন – ১, ডেন – ২, ডেন – ৩ এবং ডেন – ৪।
সহজ কথায়, একজন মানুষ তার সারা জীবনে সর্বোচ্চ চার বার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হতে পারেন।
অর্থাৎ একবার একটি ধরনে আক্রান্ত হবার পর তা সেরে গেলে, তার শরীরে যে এন্টিবডি তৈরি হয়, তা সারা জীবনের জন্য কাজ করে।
এরপর যদি তিনি পুনরায় আক্রান্তও হন, সেটি হবে ডেঙ্গুর ভিন্ন কোন ধরন।
অধ্যাপক গুলনাহার বলছেন, যতদিন রক্তে ভাইরাস থাকবে, ততদিন রোগীর শরীরে জ্বর থাকবে।
কেবলমাত্র রক্ত জীবাণুমুক্ত হলেই ডেঙ্গু জ্বর সেরে যায় একজন আক্রান্ত ব্যক্তির।
ডেঙ্গু আক্রান্ত ব্যক্তির জ্বর সারলেই কি সুস্থ?
অধ্যাপক গুলনাহার বলছেন, প্রথমবার ডেঙ্গু হলে অনেকেই তা বুঝতে পারেন না। সামান্য শরীর ব্যথা ও একটু জ্বরের লক্ষ্মণ থাকলেও সাধারণত এসময় সর্দিকাশিও থাকে না।
একে ব্রেকবোন ফিভারও বলা হয়। পাঁচ থেকে সাত দিনের মধ্যেই এই জ্বর ভালো হয়ে যায়।
তবে দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হলে, অর্থাৎ অন্য আরেকটি সেরোটাইপে আক্রান্ত হলে রোগীর শরীরে জটিলতা তৈরি হয়।
কারণ প্রথম বার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার পর শরীরে যে এন্টিবডি তৈরি হয়, সেটার সঙ্গে নতুন ভাইরাসের এন্টিজেনের এক ধরনের রিএকশন হয়। যার ফলে হেমোরেজ বা প্লাটিলেট কমে যাওয়ার মতো জটিলতা তৈরি হয়।
ডেঙ্গু আক্রান্ত হলে, ক্ষেত্রবিশেষে প্রথমে খুব জ্বর ওঠার পর তা কমে যায়। এসময় কিছুটা সুস্থ বোধ হলেও, এটিই আসলে সবচেয়ে জটিল পর্যায়। কেননা এসময়েই আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরে প্লাটিলেট কমে যায় এবং রক্তপাতের সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
এ সময় সুস্থ বোধ করায় শিশুরাও খেলাধুলা করতে চায়। তবে এটা একেবারেই করা যাবে না। এই সময়ে যেকোনো ধরনের পরিশ্রমের কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে এবং সম্পূর্ণ বিশ্রাম করতে হবে।
এডিস মশা কতদিন বাঁচে এবং কখন কামড়ায়?
কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার বলছেন, একটি পূর্ণ বয়স্ক এডিস মশা গড়ে ১৫-৪০ দিন বাঁচে।
মূলত তাপমাত্রার ওপর এডিস মশার আয়ু নির্ভর করে।
যেমন, শীতকালে এডিস মশা বেশি বাঁচে, আবার গরম কালে এডিস মশার বৃদ্ধি ও বংশবিস্তার দ্রুত হয় বলে এ সময়ে এডিস মশা কম বাঁচে।
একসময় বলা হতো ডেঙ্গু মশা শুধুমাত্র দিনের বেলা কামড়ায়। কিন্তু সে ধারণা এখন আর কাজ করছে না।
কিন্তু সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, এডিস মশা তার চরিত্র বদলেছে। এখন দিনে বা রাতে সব বেলাতেই কামড়াতে পারে এডিস এজিপ্টি, বিশেষ করে রাতে যদি ঘর আলোকিত থাকে।
এডিস মশা কতবার কামড়ায়?
কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক কবিরুল বাসার বলেছেন, ল্যাবে করা পরীক্ষায় দেখা গেছে, একটি এডিস মশা জীবদ্দশায় গড়ে চার থেকে ছয় বার কামড়ায়।
কেবল মাত্র স্ত্রী মশাই কামড়ায়। ফলে একমাত্র স্ত্রী এডিস মশাই ডেঙ্গুর জীবাণু বহন করে। আর স্ত্রী এডিস মশাও কেবল মাত্র পেটে ডিম থাকা অবস্থাতে কামড়ায়।
এডিস মশা কীভাবে বাহক হয়? কতদিন থাকে?
এডিস মশা কামড়ালেই ডেঙ্গু হয়- এমন একটি ভুল ধারনা অনেকের মধ্যেই প্রচলিত রয়েছে, যা সঠিক নয়।
আরেকটি ভুল ধারনা হলো যে আক্রান্ত কাউকে কামড়ানোর পর পরই সুস্থ একজনকে কামড়ালে তারও ডেঙ্গু জ্বর হবে।
কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক কবিরুল বাশার বলেন, এডিস মশার মাধ্যমে তখনই একজন ব্যক্তি ডেঙ্গু আক্রান্ত হবেন, যখন মশাটি ভাইরাস ইনফেক্টেড অথবা ভাইরেমিক হবে।
একটা এডিস মশা ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীকে কামড়ে যখন ভাইরাস ছড়ানোর উপযোগী হয় তখন এটাকে বলা হয় ভাইরেমিক। মূলত আক্রান্ত কাউকে কামড়ানোর পর ডেঙ্গু মশাকে ভাইরাস বিস্তারের উপযোগী হতে একটি জীবনচক্র পূরণ করতে হয়।
অর্থাৎ আক্রান্ত কাউকে কামড়ানোর মাধ্যমে মশার দেহে ভাইরাসটি প্রবেশ করে। এরপর ডিম পারা এবং বংশবিস্তারের মাধ্যমে ওই মশা ডেঙ্গুর ভাইরাস ছড়াতে সক্ষম হয়, অর্থাৎ ভাইরেমিক হয়। এরপর যতদিন মশাটি বেঁচে থাকবে ততদিন পর্যন্ত ডেঙ্গুর জীবাণু ছড়াতে পারবে।
এছাড়াও জীবাণু বহনকারী ওই মশা যত ডিম পারে, তার সবগুলোতেই ভাইরাস থেকে যায়। আর সেই ডিম যদি প্রকৃতিতে অনুকূল পরিবেশ পায় তবে সেখান থেকে জন্মানো মশার কামড়েও ডেঙ্গুর ভাইরাস ছড়াতে পারে। এই প্রক্রিয়াকে বলা হয় ট্রান্সওভারিয়াল ট্রান্সমিশন।
এভাবে ভাইরাসের বাহক হয়ে পাঁচ থেকে ১০ শতাংশ ডেঙ্গু মশা জন্মাতে পারে বলে জানান কীটতত্ত্ববিদ ড. কবিরুল বাশার।
ডেঙ্গু কি ছোঁয়াচে রোগ?
ডেঙ্গু কোন ছোঁয়াচে রোগ নয়, এটি কেবল মাত্র মশার মাধ্যমেই ছড়ায়। মানুষ থেকে মানুষে ছড়ায় না।
অর্থাৎ ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগীকে স্পর্শ করলে, একই বিছানায় ঘুমালে কিংবা তার ব্যবহৃত কিছু ব্যবহার করলে, অন্য কারো এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার সুযোগ নেই।
এডিস মশা ব্যতীত স্পর্শ বা অন্য কোনভাবে এই রোগ ছড়ানোর উপায় নেই।
এমনকি অন্য প্রজাতির মশার মাধ্যমেও ডেঙ্গু ছড়ায় না।
ডেঙ্গু হলে কী খাবার খেতে হয়?
রোগীকে স্বাভাবিক সব ধরণের নরম খাবার খেতে দেয়ার পরামর্শ দেন চিকিৎসকরা
ডেঙ্গু হলে রোগীকে স্বাভাবিক সব ধরণের নরম খাবার খেতে দেয়ার পরামর্শ দেন চিকিৎসকরা।
অধ্যাপক গুলনাহার বলেন, ডেঙ্গু হলে রোগীর শরীরে পানি স্বল্পতা হয়। তাই এই সময় তরল জাতীয় খাবার বেশি খাওয়াতে হয়।
সেইসাথে বাড়িতে ফল থেকে বের করা জুস, স্যুপ, ডাবের পানি, ওরস্যালাইন, বা অন্যান্য তরল খাবার প্রচুর পরিমাণে দেয়া যেতে পারে। এগুলো শরীরের পানি এবং ইলেক্ট্রোলাইট ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করবে।
তবে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীর ক্ষেত্রে খাবারে কিছু বিধিনিষেধ থাকতে পারে। এক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
“খাবারের মধ্যে ভারসাম্য থাকতে হবে, অনেককে দেখেছি দিনে ১০-১২টা ডাব খেতে, অনেকে লিটারে লিটারে পানি খাচ্ছে এগুলো অস্বাভাবিক।
আবার কিছু না করাও ঠিক না। যদি কারও দিনে তিন চার ঘণ্টা পর পর প্রস্রাব হয়, প্রস্রাবের রং হলুদ না হয়, তারমানে তার আর্দ্রতা স্বাভাবিক আছে” বলেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক অনিরুদ্ধ ঘোষ।
ডেঙ্গু প্রতিরোধে যা করবেন
বাড়ির আশপাশ যতটা সম্ভব পরিষ্কার রাখতে চেষ্টা করুন।
ঘরের ভেতরে থাকা ফুলের টব কিংবা ভাঙা প্লাস্টিকের বোতল, ডাবের খোসা, টায়ার অথবা পলিথিন থাকলে তা দ্রুত পরিষ্কার করে ফেলুন এবং ফুলের টব থেকে জমে থাকা পানি নিষ্কাশন করুন।
মশা নিধনের জন্য সপ্তাহে অন্তত তিন বার স্প্রে বা ফগিং করুন।
বাড়ির বাইরে যাওয়ার সময় মশা নিধনে ব্যবহৃত ক্রিম রাখতে পারেন সঙ্গে।
সন্ধ্যার পর বাড়ির ছোট থেকে বড় সদস্যরা মশারি ব্যবহার করতে পারেন।
যেখানে সেখানে জমে থাকা বৃষ্টির পানি পরিষ্কার করে ফেলুন কারণ এতে এডিস মশা ডিম পেড়ে থাকে এই সময়।
মশার প্রকোপ থেকে বাঁচতে মশারির পাশাপাশি ম্যাট ব্যবহার করতে পারেন।
বাড়ির ছোট সদস্যদের ফুল হাতা জামা পরিয়ে রাখুন এবং মশা যাতে না কামড়াতে পারে সেদিকে লক্ষ্য রাখুন। প্রয়োজনে মশা নিধন ক্রিম ব্যবহার করুন।