রক্তের রোগ সেপসিসে আক্রান্ত হলে প্রায় ৫০ শতাংশ রোগীই মৃত্যুবরণ করেন বলে গবেষকরা জানিয়েছেন।
রোববার (৯ এপ্রিল) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডেকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘এ’ ব্লক অডিটোরিয়ামে রক্তদূষণ, জীবাণুদুষণ বা রক্তে বিষক্রিয়া সেপসিস বা সেপ্টিসেমিয়া নিয়ে সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়েছে।
সেমিনারে জানানো হয়, জীবাণুদূষণ বা ইংরেজিতে সেপসিস হলো খুব মারাত্মক অসুস্থতা, যা ব্যাকটেরিয়া (জীবাণু) দ্বারা রক্তের কার্যক্ষমতাকে সম্পূর্ণভাবে পরাজিত করে। শরীরের একটি সংক্রমণ প্রতিরোধে শরীর অনেক বেশি প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে উঠলে সেপসিস হয়। রক্তদূষণের এই রোগে বিশ্বজুড়ে পাঁচজনের একজন মৃত্যুবরণ করেন। এটি রক্তের বিষ হিসাবেও পরিচিত। বছরে ১ কোটি ১০ লাখ মানুষ মারা যাচ্ছে। এই সংখ্যা ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সংখ্যার চাইতেও বেশি। সেপসিসে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয় দরিদ্র এবং মধ্যম আয়ের দেশের মানুষ। শতাংশের হিসেবে যা প্রায় ৮৫ শতাংশ। সবচেয়ে ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে শিশুরা। পাঁচ বছরের কম বয়সী ১০ জন শিশুর মধ্যে চারজনের সেপসিসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
সেমিনারে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, সেপসিসে আক্রান্ত রোগীর ফুসফুস কিডনিসহ বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ অকার্যকর করে দেয়। সেপসিসে মৃত্যুর হার প্রায় ৫০ শতাংশ এবং এই রোগে আক্রান্ত হয়ে যারা আইসিইউতে ভর্তি হয় সেক্ষেত্রে মৃত্যু হার আরও বেশি। এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে শিশু ও বয়স্করা অধিক মৃত্যু ঝুঁকিতে থাকে। তবে সেপসিসে আক্রান্ত ব্যক্তিকে দ্রুত ও যথাযথ চিকিৎসা নিশ্চিত করতে পারলে অনেককে বাঁচানো সম্ভব। রোগ প্রতিরোধের ক্ষেত্রে অবশ্যই গুরুত্ব দিতে হবে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডেকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের বলেন, রক্তদূষণ বা রক্তে বিষক্রিয়া সেপসিস বা সেপ্টিসেমিয়া নিয়ে আয়োজিত এই গুরুত্বপূর্ণ সেমিনার এই রোগে আক্রান্ত রোগীর যথাযথ উন্নত কার্যকরী চিকিৎসা নিশ্চিত করতে বিরাট অবদান রাখবে, যা সেপসিসে আক্রান্ত রোগীদের মৃত্যু হার হ্রাসে ভূমিকা রাখবে।
সেমিনারে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (একাডেমিক) অধ্যাপক ডা. একেএম মোশাররফ হোসেন, উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. ছয়েফ উদ্দিন আহমদ প্রমুখসহ বিভিন্ন অনুষদের ডিন, বিভিন্ন বিভাগের চেয়ারম্যান, বিভিন্ন স্তরের শিক্ষক, কনসালটেন্ট, চিকিৎসক ও রেসিডেন্টগণ উপস্থিত ছিলেন।
সেমিনারে সভাপতিত্ব করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় সেন্ট্রাল সাব কমিটির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. বেলায়েত হোসেন সিদ্দিকী। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন সহযোগী অধ্যাপক ডা. সম্প্রীতি ইসলাম।
এতে বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন জেনারেল সার্জারি বিভাগে অধ্যাপক ডা. মো. আবুল কালাম চৌধুরী, আইসিইউ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান সজীব, প্যাথলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. কাজী ফারহানা খানম।
সেমিনারে আরও বলা হয়, জীবাণুদূষণ অথবা সেপ্টিসেমিয়া খুবই মারাত্মক অসুস্থতা, যার মাধ্যমে জীবাণু রক্তে ছড়িয়ে পড়ে এবং রক্তের কোষগুলির কার্যক্ষমতা সম্পূর্ণভাবে লোপ পায়। এটি দেহের প্রধান অঙ্গসমূহ যেমন—যকৃত, বৃক্ক (কিডনি), হৃদপিন্ড, ফুসফুস, মস্তিষ্ক, অস্ত্র, এড্রেনাল গ্রন্থিকে সংক্রমিত করে। বিশেষ করে যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম, দীর্ঘমেয়াদি অসুস্থতা আছে বা মাল্টি ড্রাগ রেজিস্ট্রান্স জীবাণুর দ্বারা সংক্রমিত রোগীর দ্রুত অবস্থার অবনতি ঘটে। জীবাণু রক্তে প্রবেশের পর মানবদেহে অনেক পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়। জীবাণুর কোষপ্রাচীরের অংশ মানবদেহের রক্তনালির কোষ, মনোসাইট এবং নিউট্রোফিলকে সক্রিয় করে এবং বিক্ষত-প্রদাহপূর্ব সাইটোকাইন নিঃসরণ করে। এর ফলে রক্ত জমাট বাঁধার প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত ও রক্তচাপ কমে যায়। টিস্যু ওডিমা হয়। ক্ষুদ্র রক্তনালিতে থ্রম্বোসিস হয়। ফলাফল স্বরূপ অঙ্গ ও অন্ত্রসমূহে অর্গান ফেইলর হয়। শেষ পর্যন্ত রোগীর সেপ্টিপসিম ডেভেলপ করে। রোগীকে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে ভর্তি করাতে হয় এবং শতকরা প্রায় ৫০ শতাংশ মৃত্যুবরণ করে।
সেপসিস ‘গুপ্ত ঘাতক’ হিসাবেও পরিচিত কারণ এটি শনাক্ত করা কঠিন হতে পারে। মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অতিরিক্ত কাজ করার ফলে এই সেপসিস হতে পারে। এই প্রতিরোধ ক্ষমতা কেবল সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করার পরিবর্তে শরীরের অন্যান্য অংশগুলিতেও আক্রমণ শুরু করে। এক পর্যায়ে মানুষের অঙ্গ অকেজো হয়ে যায়। এমনকি বেঁচে থাকা মানুষদেরও দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি ও অক্ষমতা নিয়ে চলতে হতে পারে। যেসব ব্যাকটেরিয়া এবং ভাইরাসের কারণে ডায়রিয়া সংক্রমণ বা ফুসফুসের রোগ হয়ে থাকে সেগুলোই সেপসিস হওয়ার পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ। সেপসিসে আক্রান্ত ব্যক্তির হার্ট রেট স্বাভাবিকের চাইতে বেশি হয়।
রোগের চিকিৎসা হলো রোগীকে সাধারণত হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা বিভাগে ভর্তি করা হয়। ব্যাকটেরিয়া (জীবাণু) প্রতিরোধক ওষুধ ও তরল একটি শিরার মধ্য দিয়ে দেওয়া হয়। অক্সিজেন দেওয়া হয় এবং যে ওষুধ রক্তচাপ বৃদ্ধি করে, প্রয়োজনে তাও দেওয়া হয়। বিকল বৃক্ক বা কিডনির জন্য ডায়ালাইসিস করা প্রয়োজন। অকৃতকার্য ফুসফুসের জন্য একটি যান্ত্রিক শ্বাসযন্ত্র প্রয়োজন হয়। কিছু রোগীর জন্য ক্ষমতাশালী প্রদাহনিরোধক ওষুধ যেমন, করটিকোস্টেরয়েডস অথবা সহায়ক মানব-সক্রিয় প্রোটিন ‘সি’ দ্বারা চিকিৎসা করা উপকারী হতে পারে।
রোগের প্রতিরোধ হিসেবে নির্ধারিত সুপারিশ ও সতর্ক অনুসরণ করে সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি কমানো যেতে পারে। বিশেষভাবে হাসপাতালের শিশুদের জন্য চিকিৎসা-শাস্ত্রগত পদ্ধতি সতর্কতা ও যত্ন সহকারে অনুসরণ করলে এই রোগের সংক্রমণ প্রতিরোধে সাহায্য করতে পারে।
সেপসিস প্রতিরোধের উপায় হলো—সুষ্ঠু পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা, বিশুদ্ধ পানি এবং সঠিক সময় সঠিক টিকার যোগান। অন্যান্য চ্যালেঞ্জের মধ্যে একটি হলো, দেরি হওয়ার আগেই সেপসিস আক্রান্ত রোগীদের ভালোভাবে চিহ্নিত করা এবং দ্রুত তাদের চিকিৎসা শুরু করা। অ্যান্টিবায়োটিক্স বা অ্যান্টি-ভাইরাসের মাধ্যমে প্রাথমিক চিকিৎসা শুরু করলে সংক্রমণ প্রতিরোধ করা সম্ভব। নবজাতকের মধ্যে সেপসিস প্রতিরোধে আমাদের নতুন করে চিন্তা-ভাবনা দরকার এবং এই রোগের এক গুরুত্বপূর্ণ উদ্দীপক অ্যান্টিমাইক্রোবায়াল রেজিস্টেন্স মোকাবিলায় প্রয়োজন আরও বেশি সজাগ হওয়া।