বাংলাদেশে প্রতিবছর পানিতে ডুবে অনেকেই মারা যান। পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুমৃত্যুর দ্বিতীয় প্রধান কারণ পানিতে ডুবে মৃত্যু। গ্রামের শিশুরাই নয়, শহরের শিশুরাও বেড়াতে গিয়ে এমন করুণ মৃত্যুর শিকার হয়। এমনকি খুব অল্প পানিতেও শিশু মারা যেতে পারে। বেশিরভাগ শিশুই পানিতে ডুবে মারা যায় সকাল ১১টা থেকে বেলা ৩টার মধ্যে এবং মায়ের ১০০ গজ দূরত্বে। বিশেষ করে মা যখন কাজে ব্যস্ত থাকেন।
বাংলাদেশ স্বাস্থ্য ও ইনজুরি সার্ভে অনুযায়ী, এদেশে প্রতিবছর প্রায় ১৭ হাজার শিশু মারা যায় পানিতে ডুবে। যাদের বয়স ১ থেকে ৪ বছরের মধ্যে। অর্থাৎ প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৪৬ জন শিশু মারা যায়। পানিতে ডুবে বেশিরভাগ মৃত্যুর ঘটনাই ঘটে পুকুর ও খালে। বিশেষত এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর মাসে। এমনকি ১ থেকে ২ বছর বয়সী শিশুদের ক্ষেত্রে।
উপলক্ষ: বিভিন্ন কারণে মানুষ পানিতে ডুবে যেতে পারে। পানিতে ডুবে যাওয়ার কারণ জানা থাকলে সর্তক থাকার পাশাপাশি চিকিৎসায়ও অনেক সময় সুবিধা হয়। সাঁতার না জানা কোনো ব্যক্তি পুকুর, নদীতে কিংবা গভীর কোনো জলাশয়ে পড়ে গেলে, নৌ দুর্ঘটনার কবলে পড়লে, সড়ক দুর্ঘটনা হয়ে যানবাহন পানিতে পড়ে গেলে, বন্যা কিংবা নদীভাঙন বা জলোচ্ছ্বাসের সময় পানিতে পড়ে গেলে, অসাবধানতাবশত শিশু পানিতে পড়ে গেলে বা বহুবিধ দুর্ঘটনার শিকার হয়ে পানিতে ডুবে মারা যেতে পারেন।
কারণ: পানিতে ডুবে মৃত্যুর প্রধান কারণ হলো শ্বাসক্রিয়া বন্ধ হয়ে যাওয়া। পানি শ্বাসনালী ও ফুসফুসে ঢুকে গেলে মূলত এমনটি হয়। এ ছাড়া ল্যারিংক্স ও শ্বাসনালীর অনৈচ্ছিক পেশীর তীব্র সংকোচনেও শ্বাসনালীর মুখ বন্ধ হয়ে যেতে পারে। ২ থেকে ৩ মিনিট শ্বাস বন্ধ থাকলে মস্তিষ্কের অপূরণীয় ক্ষতি হয়। ৪ থেকে ৬ মিনিট শ্বাসক্রিয়া বন্ধ থাকলে মৃত্যু পর্যন্ত হয়। শ্বাসক্রিয়া বন্ধ হওয়া ছাড়াও প্রচুর পানি পান করার কারণে রোগীর পাকস্থলী ফুলে যায়।
করণীয়: পানিতে ডুবে মৃত্যু প্রতিরোধযোগ্য। এজন্য এ ধরনের মৃত্যু ঠেকাতে কিছু বিষয় অনুসরণ করতে হবে, যেমন-
১. কেউ পানিতে ডুবে গেলে আতঙ্কিত না হয়ে প্রথমে তাকে পানি থেকে তুলে আনুন। এক্ষেত্রে প্রতিটি সেকেন্ড মূল্যবান। পানি থেকে তুলে আনার ক্ষেত্রে ভালোভাবে খেয়াল রাখতে হবে, অনেক সময় উদ্ধারকারীও বিপদে পড়তে পারেন। ডুবন্ত ব্যক্তি অবলম্বন পেলেই আঁকড়ে ধরে এবং উপরে ওঠার চেষ্টা করে। ফলে ডুবন্ত ব্যক্তি উদ্ধারকারীকে সজোরে জড়িয়ে ধরতে পারে। এতে দেখা দিতে পারে বিপত্তি। ডুবন্ত কাউকে সাহায্য করতে গেলে সাবধান থাকতে হবে। তাই ডুবন্ত ব্যক্তিকে পেছন থেকে হাতসহ জড়িয়ে ধরে পানি থেকে তুলতে পারেন। এ ছাড়া লাইফ লাইন থাকলে তা ছুঁড়েও ডুবন্ত ব্যক্তিকে উদ্ধার করতে পারেন। লাইফ লাইন না থাকলে যেসব বস্তু পানিতে ভাসে এবং ডুবে যাওয়া ব্যক্তির ওজন বহন করতে পারে এমন বস্তু পানিতে ছুঁড়ে মারতে হবে। উদ্ধারকারী সাঁতার না জানলে ডুবন্ত ব্যক্তিকে ঠেলে ঠেলে তীরের দিকে নিয়ে যেতে হবে।
২. পানি থেকে তোলার পর উপুড় করে দেখতে হবে শ্বাস-প্রশ্বাস আছে কি না। নাম ধরে ডাক দিয়েও দেখা যেতে পারে তিনি সাড়া দেন কি না। যদি শ্বাস-প্রশ্বাস না থাকে বা শ্বাস নেওয়া কষ্টকর হয়, তাহলে খেয়াল করতে হবে শ্বাসনালীর কোথাও কিছু আটকে আছে কি না। এ জন্য আঙুল দিয়ে মুখের মধ্যে কাদা-মাটি থাকলে তা বের করে দিতে হবে। তার পরও শ্বাস না নিলে মাথা টানটান করে ধরে মুখ হা করাতে হবে। এবার উদ্ধারকারী ব্যক্তিকে বুক ভরে শ্বাস নিতে হবে এবং ডুবন্ত ব্যক্তির মুখের সঙ্গে এমনভাবে মুখ লাগাতে হবে যেন কোনো ফাঁকা না থাকে। শিশু বা কম বয়সী হলে নাক-মুখ একসঙ্গে মুখের মধ্যে পুড়তে হবে আর বয়স্ক ব্যক্তি হলে নাক হাত দিয়ে চেপে ধরে মুখে মুখ লাগাতে হবে। এ অবস্থায় উদ্ধারকারী জোরে শ্বাস নিয়ে ডুবন্ত ব্যক্তির মুখে মুখ লাগিয়ে শ্বাস দিতে হবে। দেখতে হবে যে, শ্বাস দেওয়ার ফলে ডুবন্ত ব্যক্তির পেট ফুলে যায় কি না। যদি পেট ফুলে যায়, তাহলে বোঝা যাবে যে কৃত্রিম উপায়ে এভাবে শ্বাস দেওয়া ঠিকমতই হচ্ছে। ডুবন্ত ব্যক্তি নিজে থেকে শ্বাস না নেওয়া পর্যন্ত এভাবে চালাতে হবে।
৩. কৃত্রিমভাবে শ্বাস প্রদানের পাশাপাশি হাত ধরে কিংবা গলার উঁচু অংশ তথা অ্যাডামস অ্যাপেলের একপাশে হাত দিয়ে দেখতে হবে যে, নাড়ির স্পন্দন আছে কি না। যদি না থাকে তাহলে বুকে চাপ দিতে হবে। বুকের বামপাশে হাত রেখে জোরে জোরে চাপ দিতে হবে, যেন বুক বেশ খানিকটা ধেবে যায়। যদি ডুবন্ত ব্যক্তি এক থেকে দুই বছরের শিশু হয়, তাহলে শিশুর বুক দুই হাত দিয়ে ধরে বুড়ো আঙুল দিয়ে চাপ দিতে হবে। এভাবে প্রতি ত্রিশবার চাপ দেওয়ার পর পূর্বের মতো দুইবার করে শ্বাস দিতে হবে। নাড়ির গতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত এরকম চক্রাকারে চালাতে হবে। এছাড়া প্রাথমিক চিকিৎসা চলার পাশাপাশি দ্রুত হাসপাতালে নেওয়ার ব্যবস্থাও করতে হবে।
৪. শিশু পানিতে থাকার কারণে শরীরের তাপমাত্রা কমে যায়। তাই শরীর গরম রাখার জন্য কাপড়-চোপড় দিয়ে ভালো করে ঢেকে রাখা উচিত। রোগীর অবস্থা ভালো থাকলে এবং শ্বাস-প্রশ্বাস নিলে ও হৃৎস্পন্দন চালু থাকলে তাকে কুসুম গরম দুধ, চা ইত্যাদি খেতে দেওয়া যেতে পারে।
যা এড়িয়ে চলবেন: পানি থেকে তুলে যে কাজগুলো এড়িয়ে চলবেন-
১. অনেকে পানি থেকে তুলেই পেটে চাপ দিয়ে বা শিশুকে উল্টো করে পেটে চাপ দিয়ে পানি বের করার চেষ্টা করেন, যা মোটেও ঠিক নয়। এতে শিশু বমি করে দিতে পারে যা আবার ফুসফুসে প্রবেশ করে পরবর্তীতে জটিলতা তৈরি করতে পারে।
২. সাঁতারে অপারদর্শী কোনো লোক ডুবন্ত মানুষকে উদ্ধার করতে যাবেন না, কারণ প্রায়ই এতে দুজনের জীবনই বিপন্ন হতে পারে।
৩. রোগীর ফুসফুস ও শ্বাসনালী থেকে পানি বের করার জন্য খুব বেশি সময় না নেওয়াই ভালো।
৪. প্রাথমিক বিপদ কাটিয়ে ওঠার পর রোগীকে দ্রুত হাসপাতালে না নিয়ে ঘরে বসিয়ে রাখবেন না।
প্রতিরোধের উপায়: পানিতে ডোবা থেকে দূরে থাকতে কিছু প্রতিরোধ ব্যবস্থা অনুসরণ করা যেতে পারে-
১. পানিতে ডোবা প্রতিরোধে সাঁতার শিখুন।
২. শিশুরা বাথটাবে কিংবা পানিভর্তি বালতিতেও ডুবে যেতে পারে। শুধু নাক-মুখ পানিতে ডুবে গেলেই শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে শিশু মারা যেতে পারে। তাই সাবধানতার কোনো বিকল্প নেই। এজন্য শিশুর নিরাপত্তায় পানি ধরে রাখার পাত্রগুলোয় ঢাকনার ব্যবস্থা করতে হবে।
৩. বেড়াতে গিয়ে শিশু পুকুর-নদীতে গোসল করার সময় ডুবে যেতে পারে। শিশুদের কোনো অবস্থায়ই জলাশয়ের কাছে বয়স্ক মানুষের তত্ত্বাবধান ছাড়া একা কিংবা দলবেঁধেও ঘুরতে যেতে দেওয়া ঠিক নয়।
৪. শিশুর মা কাজে ব্যস্ত থাকার সময় পরিবারের অন্য সদস্যের শিশুর দেখভালের দায়িত্ব নিতে হবে।
৫. গ্রামে পুকুর-খালের চারপাশে বেড়া দিয়ে দিন, যেন শিশু অসাবধানতাবশত পুকুরে যেতে না পারে।
৬. নদীপথে যাত্রার সময় লাইফ জ্যাকেট পরিধান করুন।
৭. যাদের খিঁচুনি আছে, তারা পুকুরে বা সুইমিংপুলে সাঁতার কাটা থেকে বিরত থাকবেন।