ঢাকায় আর ডেঙ্গু রোগীদের জায়গা হচ্ছে না। ডেঙ্গু ডেডিকেটেড ২০টি হাসপাতালের মধ্যে ১১টিতেই শয্যার তুলনায় সর্বোচ্চ ২৫০ শতাংশ ও সর্বনিম্ন ১২২ শতাংশ পর্যন্ত রোগী ভর্তি আছে। রোগীর চাপ সামাল দিতে কোনো কোনো হাসপাতালে ফাঁকা মেঝেতে বিছানা দিয়েও সামলানো যাচ্ছে না। কোনো কোনো হাসপাতালে চার বেডের জায়গায় ছয় বেড বিছানো হয়েছে। সেই সঙ্গে রয়েছে চিকিৎসক ও নার্স সংকট। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে, এখন আর হাসপাতালগুলো রোগী ভর্তি করাতে চাইছে না। এ নিয়ে চিকিৎসক-নার্স ও রোগীদের মধ্যে মারামারির ঘটনা পর্যন্ত ঘটতে শুরু করেছে।
এমন পরিস্থিতি সামাল দিতে রাজধানীর ডেঙ্গু রোগীদের সবচেয়ে বড় হাসপাতাল মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগী ভর্তি বন্ধের নির্দেশ দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এ হাসপাতালে আসা রোগীদের অন্য হাসপাতালে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছে। পাশাপাশি ঢাকার বাইরের ডেঙ্গু রোগীদের ডেঙ্গু চিকিৎসায় ঢাকায় না এসে যে যেখানে আছে, সেখানেই ডেঙ্গু চিকিৎসা নেওয়ার অনুরোধ জানানো হয়েছে। অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলেছেন, ঢাকায় ডেঙ্গু রোগীর চাপ এত বেড়েছে যে, এখন আর শয্যা সংকুলান হচ্ছে না।
ডেঙ্গু রোগী ভর্তি করতে না চাওয়ায় গতকাল বুধবার মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এক শিশুর বাবার সঙ্গে ওই হাসপাতালের কর্তব্যরত চিকিৎসকের বাগবিত-া ও মারামারির ঘটনা ঘটেছে। পরে ওই শিশুকে ভর্তি করা হয়।
এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবীর গতকাল এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে বলেন, দয়া করে যে যেখানে আছেন, সেখানেই চিকিৎসা নেন। আর তা না করে সবাই যদি ঢাকামুখী হতে থাকেন, তাহলে সংকট তৈরি হবে। এই রোগী তার নিজের জায়গায় চিকিৎসা না নিয়ে ঢাকায় এলে সে রাস্তায় ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এখানে এসে তাকে মেঝেতে থাকতে হবে। অথচ সারা দেশেই একটা নির্দিষ্ট প্রটোকল অনুযায়ী চিকিৎসা হচ্ছে ও চিকিৎসার ব্যবস্থা আছে। সুতরাং যে যেখানে আছেন সেখানেই চিকিৎসা নিন।
রোগী ৪০ হাজার ছাড়াল : গত ২৪ ঘণ্টায় (গতকাল বুধবার সকাল ৮টা পর্যন্ত) এ বছরের সর্বোচ্চ ২ হাজার ৬৫৩ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ও মারা গেছে ১৪ জন। এ নিয়ে এ বছর মোট রোগীর সংখ্যা দাঁড়াল ৪০ হাজার ৩৪১ জন। নতুন রোগীদের মধ্যে ১০ জন ঢাকায় ও ৪ জন ঢাকার বাইরে মারা গেছে। এ নিয়ে মারা গেল ২১৫ জন। ভর্তি রোগীদের মধ্যে ঢাকায় ১ হাজার ৩২৭ ও ঢাকার বাইরে ১ হাজার ৩২৬ জন ভর্তি হয়েছে।
মোট ভর্তি রোগীর ৫৮% ঢাকায় : গতকাল পর্যন্ত ঢাকা ও ঢাকার বাইরে মোট ডেঙ্গু রোগী ভর্তি ছিল ৮ হাজার ১৮৯ জন। তাদের মধ্যে ঢাকায় ভর্তি ছিল ৪ হাজার ৭৬০ জন, যা মোট ভর্তি রোগীর ৫৮ শতাংশ। বাকি ৪২ শতাংশ রোগী ঢাকার বাইরে বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি আছে।
মুগদায় ভর্তি বন্ধ : স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা হাসপাতাল কর্র্তৃপক্ষকে আপাতত ডেঙ্গু রোগী ভর্তি বন্ধের নির্দেশ দিয়েছেন। হাসপাতালে আসা রোগীদের বুঝিয়ে অন্য হাসপাতালে যাওয়ার পরামর্শ দিতে বলেছেন।
এ ব্যাপারে অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবীর বলেন, ‘মুগদা হাসপাতালে আর বেড বাড়ানোর সুযোগ নেই। সর্বোচ্চ সক্ষমতা পার হয়ে গেছে। আপনার সবাইকে বলবেন লোকজন যাতে মুগদায় না যায়। ওখানে বেড নেই। সবাই এক জায়গায় গেলে চিকিৎসা কী করে দেবে।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হাসপাতালের চিকিৎসকরা বলেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলেছে রোগীর চাপ কমাতে। আমরা তো ওইভাবে সেবা দিতে পারছি না। মেঝেতে রেখেও কুলানো যাচ্ছে না। অধিদপ্তর চাইছে কিছু রোগী অন্যত্র গেলে এখানে সেবার মানটা ভালো হবে। শুধু শুধু ভর্তি করলাম, ঠিকমতো চিকিৎসা দিতে পারলাম না, লাভ কি? তারপরও যারা অন্য জায়গায় যেতে চাইছে না, তাদের ভর্তি করছি।
এ হাসপাতালে ডেঙ্গু ডেডিকেটেড বেড ৬০০। সেখানে গতকালও ৫৬৬ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি ছিল। গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন রোগী ভর্তি হয়েছে ১৪১ ও ১ জন মারা গেছে। ডেঙ্গু রোগীদের জন্য এখানে বিভিন্ন ফ্লোরের খোলা জায়গায় ম্যাট্রেস বিছিয়ে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
শিশু ভর্তি নিয়ে মুগদায় হাতাহাতি : গতকাল মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশুকে ভর্তি করানো নিয়ে শিশুর বাবা ও চিকিৎসকের মধ্যে হাতাহাতির ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনায় অবশেষে শিশুটিকে হাসপাতালে ভর্তি করা হলেও তার বাবাকে পার্শ্ববর্তী থানায় নিয়ে যাওয়া হয়।
এ ব্যাপারে অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবীর বলেছেন, ‘এ ঘটনার একটা তদন্ত কমিটি করেছি। কমিটি ঘটনা বিশ্লেষণ করেছে। ভর্তি হতে আসা শিশুর বাবাকে চিকিৎসকরা অন্য হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন। এরপর শিশুর বাবা প্রচ- ক্ষেপে যান ও চিকিৎসককে মারধর করেন। পরে টুল দিয়ে তার হাতে আঘাত করেন। চিকিৎসক সারা রাত চিকিৎসা করেন। তার ওপর যদি এরকম আঘাত হয়, তাহলে সেটা খুবই গর্হিত কাজ। আমরা বলেছি বাচ্চার চিকিৎসা নিশ্চিত করেন। ওই শিশুকে ভর্তি করা হয়েছে। বাকিটুকু আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দেখেছে। তারা শিশুর বাবাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিয়েছে। এভাবে চিকিৎসককে নাজেহাল করা হলে চিকিৎসকরা চিকিৎসা দিতে ভয় পাবেন। সবাইকে সহিষ্ণু হতে হবে।’
বড় ৬ হাসপাতালেই শয্যার চেয়ে রোগী বেশি : রাজধানীর ২০টি হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসায় নির্দিষ্ট পরিমাণ শয্যা ডেডিকেটেড করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি রোগী সাতটি হাসপাতালেই শয্যার তুলনায় রোগী বেশি। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ডেডিকেটেড বেড ১২০টি। সেখানে গতকাল রোগী ভর্তি ছিল ৩০০ জন, যা শয্যার চেয়ে আড়াইগুণ বেশি। স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (মিটফোর্ড হাসপাতাল) ডেঙ্গুর বেড ১৯৫টি। সেখানে রোগী ভর্তি আছে ৩১৫ জন, যা ১৬২ শতাংশ বেশি। শিশু হাসপাতালে ডেঙ্গুর জন্য ৪৪ শয্যায় রোগী ভর্তি আছে ৮৯ জন, যা মোট শয্যার ২০২ শতাংশ বেশি। শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের ১২০ শয্যায় রোগী আছে ২০০ জন, যা ১৬৬ শতাংশ বেশি। কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতালের ৭২ শয্যায় রোগী আছে ৮৮ জন, যা শয্যার চেয়ে ১২২ শতাংশ বেশি।
৪ বেডের জায়গায় ৬ বেড করেছে কুর্মিটোলা : কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. মো. গোলাম কিবরিয়া বলেন, এখানে মোট বেড ৫০০। তার মধ্যে ডেঙ্গুর জন্য ডেডিকেটেড ৩৫০। এখন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি আছে ১৯০ জন। গত ২৪ ঘণ্টায় ভর্তি হয়েছে ৮৪ জন। ছাড়পত্র পেয়েছে ৬১ জন।
এই কর্মকর্তা বলেন, ‘এখানেও বেড ফাঁকা নেই। ৫০০ বেডের হাসপাতালে রোগী আছে ৫৭৫ জন, অর্থাৎ শয্যার তুলনায় রোগী ১১৪ শতাংশ। আমরা একটু চাপাচাপি করে রেখেছি। যেখানে চার বেড, সেখানে ছয় বেড করেছি। এভাবে বেড বাড়িয়েছি। ৩৫০ বেড করেছি। প্রয়োজনে ৪০০ করব। থাকতে একটু কষ্ট হবে। কিন্তু চিকিৎসা পাবে। আরও ১২ জন মেডিকেল অফিসার দেওয়া হয়েছে আগামী দুই মাসের জন্য। আশা করছি তারা দুয়েক দিনের মধ্যে যোগ দেবেন। তখন কিছুটা স্বস্তি হবে। ৪০ জন নার্স চেয়ে চিঠি দিয়েছি।’
ঢাকায় শয্যা বাড়ানো হচ্ছে : অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবীর বলেন, ‘ঢাকায় আরও অতিরিক্ত ২ হাজার ৫০০ বেড প্রস্তুত আছে। গত মঙ্গলবার স্বাস্থ্যমন্ত্রী প্রত্যেক হাসপাতাল কর্র্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলেছেন। সব হাসপাতালকে ২০০-৩০০ বেড বৃদ্ধির নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। মুগদাকে আর বেড বৃদ্ধি করতে বলিনি। ডিএনসিসিতে ৮০০ পর্যন্ত বেড বাড়ানো যাবে। কুর্মিটোলায় ১০০, ঢাকা মেডিকেলে ১৫০ ও কুয়েত মৈত্রীতেও আরও ১০০ বেড বাড়াতে বলেছি।’
এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ করতে বলল অধিদপ্তর : অধিদপ্তরের এ কর্মকর্তা বলেন, রোগী যদি অতিমাত্রায় বাড়তে থাকে, তাহলে সামাল দিতে কষ্ট হবে। চিকিৎসকরা সামাল দিতে পারছেন না। একজন চিকিৎসকের যেখানে ১০ জন রোগীকে চিকিৎসা দেওয়ার কথা, সেখানে ২০-৩০ জনকে সেবা দিতে হচ্ছে। এখন দরকার এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ করা। আমরা যদি এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারি, তাহলে ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা খুব কঠিন হবে।




