ডেঙ্গু জ্বর কি, কেন এবং করণীয়..

ডাঃ সিরাজুল ইসলাম (সান)

0
85

ডেঙ্গু জ্বর একটি এডিস মশা বাহিত ডেঙ্গু ভাইরাস জনিত গ্রীষ্মমণ্ডলীয় রোগ। এডিস মশার কামড়ের মাধ্যমে ভাইরাস সংক্রমণের তিন থেকে পনেরো দিনের মধ্যে সচরাচর ডেঙ্গু জ্বরের উপসর্গগুলো দেখা দেয়। ডেঙ্গুর আরেক নাম “হাড়-ভাঙা জ্বর” যা মাংশপেশি ও হাড়ের সংযোগস্থলে ব্যথা থেকে এসেছে।

১৭৭৯ সালে ডেঙ্গুর প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায়। বিংশ শতকের প্রথমভাগে ডেঙ্গুর ভাইরাস উৎস ও সংক্রমণ বিশদভাবে জানা যায়। এশিয়া, দক্ষিণ আমেরিকা ও অন্যান্য মহাদেশের ১১০টিরও বেশি দেশে ডেঙ্গু মহামারীর আকার নিয়েছে। সারা পৃথিবী জুড়ে বছরে ৫০ থেকে ১০০ মিলিয়ন লোকের মধ্যে এটি সংক্রামিত হয়, যার মধ্যে ৫ লক্ষকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়, এবং প্রায় ১২৫০০-২৫০০০ মৃত্যু ঘটে। ট্রপিক্যাল রোগ হিসাবে গুরুত্বের দিক দিয়ে ম্যালেরিয়ার পরেই ডেঙ্গুর স্থান। ১৯৬০ থেকে ২০১০-এর মধ্যে ডেঙ্গুর ঘটনা ৩০ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।

কয়েক প্রজাতির এডিস মশকী (স্ত্রী মশা) ডেঙ্গু ভাইরাসের প্রধান বাহক। যেগুলোর মধ্যে এডিস ইজিপ্টি মশকী প্রধানতম। ভাইরাসটির পাঁচটি সেরোটাইপ পাওয়া যায়।

  • ডেঙ্গুরপ্রধান লক্ষণ:  জ্বর ৯৯ থেকে ১০৬ ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্ত তাপমাত্রা উঠতে পারে। জ্বর টানা থাকতে পারে, আবার ঘাম দিয়ে জ্বর ছেড়ে দেওয়ার পর আবারও আসতে পারে। এর সঙ্গে শরীরে ব্যথা, মাথাব্যথা, চোখের পেছনে ব্যথা এবং চামড়ায় লালচে দাগ বা ফুসকুড়ি দেখা যায়। তবে এগুলো না থাকলেও ডেঙ্গু হতে পারে।

সাধারণভাবে, ডেঙ্গু ভাইরাসে আক্রান্তরা হয় উপসর্গবিহীন (৮০%) অথবা সাধারণ জ্বরের মত সামান্য উপসর্গ। ইনকিউবিশন পিরিয়ড (উপসর্গসমূহের সূত্রপাত থেকে রোগের প্রাথমিক পর্যায়ের মধ্যবর্তী সময়) স্থায়ী হয় ৩-১৪ দিন, কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তা হয় ৪-৭ দিন। অতএব, আক্রান্ত এলাকা-ফেরত পর্যটকদের ডেঙ্গু হয় না যদি ঘরে ফেরার ১৪ দিনের বেশি পরে জ্বর ও অন্যান্য উপসর্গ শুরু হয়।

  • এডিস মশা কখন কামড়ায়

ডেঙ্গু জ্বরের জন্য দায়ী এডিস মশা অন্ধকারে কামড়ায় না। সাধারণত সকালের দিকে এবং সন্ধ্যার কিছু আগে এডিস মশা তৎপর হয়ে উঠে। এডিস মশা কখনো অন্ধকারে কামড়ায় না।

ফলে দিনের বেলায়ই এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। বিভিন্ন স্থানে ৪/৫ দিন জমে থাকা বৃষ্টির পানি ও পরিষ্কার পানি হল এডিস মশার বংশ বিস্তারের স্থান, তাই মশা বংশ বিস্তার বন্ধ করতে পারলে এ রোগ ছড়ানোর সম্ভাবনাও কমে যায়।

  • ডেঙ্গুর জ্বরের সময়কাল

সাধারণত জুলাই থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত ডেঙ্গু জ্বরের প্রকোপ থাকে। কারণ এ সময়টিতে এডিস মশার বিস্তার ঘটে। কিন্তু এবার দেখা যাচ্ছে ডেঙ্গু জ্বরের সময়কাল আরো এগিয়ে এসেছে। এখন জুন মাস থেকেই ডেঙ্গু জ্বরের সময় শুরু হয়ে যাচ্ছে।

 

  • ডেঙ্গু জ্বর সংক্রমণের কোর্স তিনটি পর্যায়ে বিভক্ত: প্রাথমিক, প্রবল এবং আরোগ্য।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) ১৯৯৭ সালের বর্গীকরণে ডেঙ্গুকে অবিচ্ছিন্ন জ্বর, ডেঙ্গু জ্বর, এবং ডেঙ্গু হেমারেজিক ফিভারে বিভক্ত করা হয়। ডেঙ্গু হেমারেজিক ফিভারকে আবার I–IV গ্রেডে উপবিভক্ত করা হয়।

প্রাথমিক পর্যায়ে থাকে অত্যধিক জ্বর, প্রায়শ ৪০ °সে (১০৪ °ফা)-র বেশি, সঙ্গে থাকে সাধারণ ব্যথা ও মাথাব্যথা; বমিও হতে পারে। এটি সাধারণত দুই থেকে সাতদিন স্থায়ী হয়।

প্রবল পর্যায়ে কিছু মানুষের শরীরে ফুসকুড়ি হতে পারে, সুক্ষ রক্তনালি ছিড়ে যাওয়ার ফলে petechiae (চামড়ায় ছোট লাল দাগ যা চেপে ধরে থাকলেও মিশে যায় না) দেখা দিতে পারে, এবং মুখ ও নাকের ভেতর থেকে হালকা রক্তপাত হতে পারে। সাধারণত এই পর্বে গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল এলাকা থেকে তীব্র রক্তক্ষরণ (ডেঙ্গু শক সিনড্রোম) ঘটতে পারে এবং এটি সাধারণত এক থেকে দুই দিন স্থায়ী হয়।

আরোগ্য পর্যায়ে রোগির খুব দ্রুত উন্নতি হয়, এই সময় শরিরে খুব চুলকানী এবং হৃৎস্পন্দন কমে যেতে পারে। চামড়ায় ফুসকুড়ি হতে পারে, যার ফলে চামড়ার উপরিস্তর উঠে যেতে পারে। যদি এটা মস্তিষ্ককে প্রভাবিত করে, তবে চেতনা হ্রাস ঘটতে পারে। এটি সাধারণত দুই থেকে তিন দিন স্থায়ী হয়।

  • ডেঙ্গু জ্বরের রোগীদের তিনটি ভাগ রয়েছে:

এ ভাগগুলো হচ্ছে – ‘এ’, ‘বি’ এবং ‘সি’।

ক্যাটাগরির রোগীরা নরমাল থাকে। তাদের শুধু জ্বর থাকে। অধিকাংশ ডেঙ্গু রোগী ‘এ’ ক্যাটাগরির। তাদের হাসপাতালে ভর্তি হবার কোন প্রয়োজন নেই।

 ‘বিক্যাটাগরির ডেঙ্গু রোগীদের সবই স্বাভাবিক থাকে, কিন্তু শরীরে কিছু লক্ষণ প্রকাশ পায়। যেমন তার পেটে ব্যথা হতে পারে, বমি হতে পারে প্রচুর কিংবা সে কিছুই খেতে পারছে না। অনেক সময় দেখা যায়, দুইদিন জ্বরের পরে শরীর ঠাণ্ডা হয়ে যায়। এক্ষেত্রে হাসপাতালে ভর্তি হওয়াই ভালো।

সিক্যাটাগরির ডেঙ্গু জ্বর সবচেয়ে খারাপ। এক্ষেত্রে হাসপাতাল ভর্তি হওয়াই ভালো। কিছু-কিছু ক্ষেত্রে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র বা আইসিইউ’র প্রয়োজন হতে পারে।

  • সতর্ক লক্ষণ:

পেট ব্যাথা, রক্ত বমি

যকৃৎ বড় হয়ে যাওয়া

পেশিতে রক্তক্ষরণ

অনুচক্রিকা কমে যাওয়া

  • ডেঙ্গু জ্বরের রোগনিরূপণ:

ডেঙ্গু জ্বরের রোগনিরূপণ মাইক্রোবায়োলজিক্যাল টেস্টিং-এ হতে পারে। PCR, ভাইরাল অ্যান্টিজেন (NS1) শনাক্তকরণ অথবা নির্দিষ্ট অ্যান্টিবডি (সেরোলজি) দ্বারা সেল কালচারনিউক্লিক অ্যাসিড শনাক্তকরণ-এ ভাইরাসকে বিচ্ছিন্ন করে এটা হতে পারে। তবে রোগের প্রাথমিক পর্যায়ে সব টেস্টগুলিই নেগেটিভ হতে পারে। প্রথম সাত দিনে PCR এবং ভাইরাল অ্যান্টিজেন ডিটেকশন অনেক বেশি নির্ভুল। ডেঙ্গু ভাইরাস-ভিত্তিক অ্যান্টিবডি, IgG ও IgM টেস্ট, সংক্রমণের পরবর্তী পর্যায়ে রোগনিরূপণকে দৃঢ়ীকৃত করতে কাজে লাগতে পারে। IgG এবং IgM উভয়ই ৫-৭ দিন পর উৎপন্ন হয়। প্রাথমিক সংক্রমণের পর রক্তে IgG ১৪-২১ দিন পর উচ্চতম মাত্রায় আরোহণ করে।

  • বিশ্রামে থাকতে হবে

জ্বর হলে বিশ্রামে থাকতে হবে। জ্বর নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করা উচিত নয়। একজন ব্যক্তি সাধারণত প্রতিদিন যেসব পরিশ্রমের কাজ করে, সেগুলো না করাই ভালো। পরিপূর্ণ বিশ্রাম প্রয়োজন।

  • কী খাবেন?

প্রচুর পরিমাণে তরল জাতীয় খাবার গ্রহণ করতে হবে। যেমন – ডাবের পানি, লেবুর শরবত, ফলের জুস এবং খাবার স্যালাইন গ্রহণ করা যেতে পারে। এমন নয় যে প্রচুর পরিমাণে পানি খেতে হবে, পানি জাতীয় খাবার গ্রহণ করতে হবে।

 যেসব ঔষধ খাওয়া উচিত নয়

ডেঙ্গু জ্বর হলে প্যারাসিটামল খাওয়া যাবে। স্বাভাবিক ওজনের একজন প্রাপ্ত বয়স্ক ব্যক্তি প্রতিদিন সর্বোচ্চ চারটি প্যারাসিটামল খেতে পারবে। কিন্তু কোন ব্যক্তির যদি লিভার, হার্ট এবং কিডনি সংক্রান্ত জটিলতা থাকে, তাহলে প্যারাসিটামল সেবনের আগে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে। ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হলে গায়ে ব্যথার জন্য অ্যাসপিরিন জাতীয় ঔষধ খাওয়া যাবে না।

  • জ্বর হলেই কি চিন্তিত হবেন?

এখন যেহেতু ডেঙ্গুর সময়, সেজন্য জ্বর হলে অবহেলা করা উচিত নয়। জ্বরের সাথে যদি সর্দি- কাশি, প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া কিংবা অন্য কোন বিষয় জড়িত থাকে তাহলে সেটি ডেঙ্গু না হয়ে অন্যকিছু হতে পারে। তবে জ্বর হলেই সচেতন থাকতে হবে।

  • পানি জমিয়ে না রাখা

এডিস মশা সাধারণত ডিম পাড়ে স্বচ্ছ পানিতে। এ পানি যে কোন জায়গায় জমতে পারে। বাড়ির ছাদে কিংবা বারান্দার ফুলের টবে, নির্মাণাধীন ভবনের বিভিন্ন পয়েন্টে, রাস্তার পাশে পড়ে থাকা টায়ার কিংবা অন্যান্য পাত্রে জমে থাকা পানিতে এডিস মশা বংশবিস্তার করে।

  • ডেঙ্গু ভাইরাসের কোন স্বীকৃতটিকা/ভ্যাকসিন নেই। সুতরাং প্রতিরোধ নির্ভর করে জীবাণুবাহী মশা নিয়ন্ত্রণ এবং তার কামড় থেকে সুরক্ষার উপর। ডেঙ্গু জ্বরের কোন নির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই। রোগের লক্ষণের উপর চিকিৎসা নির্ভর করে, বাড়িতে নিয়মিত দেখাশোনার সঙ্গে ওরাল রিহাইড্রেশন থেরাপি থেকে শুরু করে হাসপাতালে ভর্তি করে ইন্ট্রাভেনাস থেরাপি এবং/বা ব্লাড ট্রান্সফিউশন পর্যন্ত।

১) ডেঙ্গু রোগীদের জন্য বিশ্রাম খুব গুরুত্বপূর্ণ। এবং প্রচুর পরিমাণে তরল জাতীয় খাবার খেতে হবে।

২) ডাবের পানি, লেবুর শরবত, ফলের জুস এবং খাবার স্যালাইন খেতে পারেন। এমন নয় যে প্রচুর পরিমাণে পানি খেতে হবে, পানি জাতীয় খাবার খেলেই হবে।

৩) কমলা ও কমলার রস ডেঙ্গু জ্বরে ভালো কাজ করে। এতে আছে ভিটামিন সি এবং অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট। এই দুটি উপাদান ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ভালো কাজ করে।

৪) ডেঙ্গু হলে শরীরে তরল পদার্থের শূন্যতা সৃষ্টি হয়। তাই এ সময় বেশি করে ডাবের পানি পান করলে উপকার পাওয়া যাবে।

৫) পালংশাকে প্রচুর পরিমাণে আয়রন পাওয়া যায়, এবং এই শাকটি বেশি করে গ্রহণ করলে অতিদ্রুত প্লাটিলেট বৃদ্ধি পায়।

৬) দুধ জাতীয় ও পুষ্টিকর খাবার খাওয়া উচিৎ।

৭) বাইরে যাওয়ার সময় ফুলহাতা জামা ব্যবহার করা উচিৎ।

৮) ডেঙ্গু রোগীকে ভালোভাবে মশারী টাঙিয়ে দিতে হবে।

৯) বাড়ির আশপাশের ঝোপঝাড়, জঙ্গল, জলাশয় ইত্যাদি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে।

১০) এডিস মশা মূলত এমন বস্তুর মধ্যে ডিম পাড়ে, যেখানে স্বচ্ছ পানি জমে থাকে। তাই ফুলদানি, অব্যবহৃত কৌটা, ডাবের খোলা, পরিত্যক্ত টায়ার ইত্যাদি সরিয়ে ফেলতে হবে।

References:

  1. “Dengue and severe dengue Fact sheet N°117”. WHO. May 2015. Archivedfrom the original on 2 September 2016. Retrieved 3 February 2016.
  2. “Dengue and severe dengue”. www.who.int. Retrieved 29 February 2020.
  3. “Dengue fever: diagnosis and treatment”. Expert Review of Anti-Infective Therapy. 8 (7): 84145. doi:1586/eri.10.53PMID20586568S2CID43859902.
  4. World Health, O., Dengue: Guidelines for Diagnosis, Treatment, Prevention and Control. Dengue: Guidelines for Diagnosis, Treatment, Prevention and Control. 2009, Geneva: World Health Organization. 1-147.
  5. Bhatt, S., et al., The global distribution and burden of dengue. Nature, 2013. 496(7446): p. 504–507.

 

ডাঃ সিরাজুল ইসলাম (সান)
ট্রেইন্ড ইন এন্ডোস্কোপি, কোলনস্কপি & ERCP
গ্যাস্ট্রোলিভার & এন্ডোস্কোপি বিশেষজ্ঞ