খুব নির্দিষ্টভাবে খুবই ছোট জায়গায় প্রয়োগ করা যায় বলে চোখের বিভিন্ন ধরনের সমস্যার সমাধানে লেজার প্রয়োগ করা হচ্ছে। চোখের মধ্যে লেজার সরাসরিও প্রয়োগ করা যায়, আবার এন্ডোস্কোপির সাহায্যে অপটিক্যাল ফাইবারের মাধ্যমেও প্রয়োগ করা যায়। স্বাভাবিক দৃশ্যমান আলোর তরঙ্গের লেজার রশ্মি চোখে প্রবেশ করলে চোখের মারাত্মক কোন ক্ষতি হয় না। কারণ আমাদের চোখ দৃশ্যমান আলোয় অভ্যস্ত। এই আলো চোখের কর্নিয়া ও লেন্স ভেদ করে রেটিনায় গিয়ে পৌঁছায়। লেজারও সাধারণ আলোর মতো কর্নিয়া ও লেন্সের ভেতর দিয়ে চোখের ভেতর প্রবেশ করে। রেটিনায় পৌঁছার পর সেই লেজারের শক্তি রেটিনা শোষণ করে নেয়। তাই রেটিনার সমস্যার সমাধানে লেজার প্রয়োগ করতে হলে সরাসরি চোখের ভেতর দিয়ে লেজার রশ্মি পাঠানো যায়। অতিবেগুনি লেজার রশ্মি দিয়ে চোখের কর্নিয়া ও লেন্সের চিকিৎসা করা যায় – কারণ লেন্স ও কর্নিয়া অতিবেগুনি রশ্মি শোষণ করে।
চোখের গঠন দেখলে আমরা বুঝতে পারব, যে এটা গোলাকার ছোট্ট বলের মতো– যাকে আমরা অক্ষিগোলক বলে থাকি। এর ভেতর তরল পদার্থ থাকে এবং একটা নির্দিষ্ট চাপ বজায় রাখতে হয় সুস্থ চোখের জন্য। অনেক কারণে চোখের ভেতরের প্রেসার বা চাপ বেড়ে যেতে পারে। চাপ বেড়ে গেলে চোখে নানারকম সমস্যা দেখা দেয়। অতিরিক্ত চাপে চোখের স্নায়ু ছিঁড়ে গিয়ে মানুষ অন্ধ হয়ে যেতে পারে। এই সমস্যাকে ডাক্তারি ভাষায় গ্লুকোমা (glaucoma) বলে। লেজারের সাহায্যে এই সমস্যার সমাধান করা যায়। চোখে আর্গন লেজার প্রয়োগ করে চোখের ড্রেনেজ সিস্টেমে অথবা চোখের মণিতে (iris) সূক্ষ্ম ছিদ্র করে কিছু তরল বের করে অক্ষিগোলকের চাপ কমিয়ে দেয়া হয়। চোখের ভেতর টিউমার হলে লেজার সার্জারির মাধ্যমে সেই টিউমার দূর করা যায়। অনেক সময় মাথায় আঘাত পেলে চোখের রেটিনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে রেটিনায় ক্ষত তৈরি হতে পারে। লেজারের সাহায্যে এই ক্ষত জুড়ে দেয়া যায়।
ডায়াবেটিক রোগীদের চোখ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অত্যধিক ব্লাড সুগারের কারণে রোগীর রেটিনার রক্তনালী ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ডাক্তারি ভাষায় এর নাম ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি। রক্তনালীর সমস্যায় রেটিনার কোষে রক্তপ্রবাহ ব্যাহত হয়। আমাদের শরীর নিজে নিজে অনেক সমস্যার সমাধান করে ফেলে। রেটিনার কোষে রক্তচলাচল ঠিক রাখার জন্য সেখানে নতুন রক্তনালী তৈরি হয়। কিন্তু কম জায়গায় বেশি রক্তনালী হয়ে গিয়ে নতুন সমস্যা তৈরি করে। আস্তে আস্তে রোগী অন্ধ হয়ে যেতে থাকে। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে থাকলে রোগীর এই সমস্যা তত মারাত্মক হয় না, কিন্তু ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে না থাকলে রোগীর চোখের সমস্যা বাড়তে থাকে। তখন লেজার সার্জারি করে এই সমস্যার সমাধান করা হয়।
চোখের ছানি পড়া (cataract) বয়স্ক মানুষের চোখের একটি স্বাভাবিক সমস্যা। চোখের লেন্স স্বচ্ছতা হারিয়ে ক্রমশ ঘোলা হতে থাকলে দৃষ্টি ঘোলাটে হয়ে যায়। প্রচলিত চিকিৎসা হলো চোখের ছানি কাটা– বা সার্জারি করে চোখের ঘোলাটে লেন্স ফেলে দিয়ে একটা প্লাস্টিকের স্বচ্ছ কৃত্রিম লেন্স বসিয়ে দেয়া। এতে রোগী নতুন দৃষ্টি পায়। কিন্তু অনেক রোগীর ক্ষেত্রে কিছু কিছু সমস্যা দেখা দেয়। নতুন লেন্সের চারপাশে ময়লা আবরণ জমে নতুন লেন্সও ঘোলা হতে থাকে। সেক্ষেত্রে লেজার দিয়ে সেই ময়লা আবরণ বাষ্পীভূত করে ফেলা যায়।
চোখের হ্রস্বদৃষ্টি (myopia) হলে আমরা সাধারণত মাইনাস পাওয়ারের চশমা পরে কাজ চালিয়ে নিতে পারি। কিন্তু এই সমস্যার স্থায়ী সমাধান করা যায় লেজারের মাধ্যমে। এই সমস্যা হয় মূলত কর্নিয়া যদি সঠিক কোণে আলোর প্রতিসরণ ঘটাতে না পারে। তখন চোখের লেন্সে আলো সঠিক কোণে প্রবেশ করতে পারে না। ফলে রেটিনায় প্রতিবিম্ব তৈরি হয় না। এই সমস্যার সমাধান করার জন্য লেজারের সাহায্যে কর্নিয়ার আকৃতির পরিবর্তন ঘটানো হয়, যাতে কর্নিয়ার ভেতর দিয়ে আলো যাবার সময় সঠিকভাবে প্রতিসৃত হয়ে চোখের লেন্সে ঢোকে। এই পদ্ধতির নাম ফটোরিফ্রাকটিভ কেরাটেকটোমি (photorefractive keratectomy)।
এ পদ্ধতির আরো আধুনিকায়ন ঘটেছে নতুন একটি পদ্ধতিতে যার নাম ল্যাসিক (LASIK – laser assisted in-situ keratomileusis)। এই পদ্ধতিতে প্রথমে কর্নিয়ার ওপরের অংশ কেটে আলাদা করে রাখা হয়। তারপর সেখানে আলট্রাভায়োলেট লেজার প্রয়োগ করে প্রয়োজন মতো কর্নিয়ার আকৃতির পরিবর্তন করা হয়। তারপর কর্নিয়ার ওপরের অংশ যেটা আলাদা করে রাখা হয়েছিল সেটা আবার বসিয়ে দেয়া হয়। রোগী কয়েকদিনের মধ্যেই সেরে ওঠে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই রোগীকে আর চশমা পরতে হয় না। তবে কোনো কোনো রোগীর ক্ষেত্রে ল্যাসিক অপারেশানের কয়েক বছর পর আবার চশমা পরতে হতে পারে।






