দেশে করোনা মহামারি শুরুর পর হাত ধোয়ার বিষয়ে যতটা মনযোগী ছিল মানুষ, সেটি এখন আর নেই। আবার বাড়ির বাইরে সাধারণ মানুষের হাত ধোয়ার ব্যবস্থাও তেমন নেই।
২০১৮ সালের জাতীয় হাইজিন সার্ভের তথ্য বলছে, ২৫ শতাংশ মানুষের হাত ধোয়ার অভ্যাস নেই। আবার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও ইউনিসেফের সর্বশেষ প্রকাশিত যৌথ পর্যবেক্ষণ কর্মসূচির (জয়েন্ট মনিটরিং প্রোগ্রাম—জেএমপি) প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ৬৩ শতাংশ হাসপাতালে হাত ধোয়া বা জীবাণুমুক্ত করার কোনও ব্যবস্থা নেই। সর্বজনীন হাত ধোয়ার চর্চা নিশ্চিত করতে একটি কৌশলপত্র তৈরি করেছে স্থানীয় সরকার বিভাগ। এতে বলা আছে, ২০৩০ সালের মধ্যে হাত ধোয়ার সর্বজনীন চর্চা নিশ্চিত করতে অবকাঠামোসহ নানা ধরনের সুবিধা দরকার। সেগুলো এখনও নিশ্চিত করা যায়নি।
এমন প্রেক্ষাপটে রবিবার (১৫ অক্টোবর) পালিত হচ্ছে ‘বিশ্ব হাত ধোয়া দিবস’। এবারের প্রতিপাদ্য— ‘পরিষ্কার হাত নাগালের মধ্যেই আছে’। সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার বৈশ্বিক এবং স্থানীয় দৃষ্টিভঙ্গি প্রচার করার জন্য বিশ্ব হাত ধোয়া অংশীদার (জিএইচপি)-এর উদ্যোগে ২০০৮ সাল থেকে ১৫ অক্টোবর দিনটি ‘বিশ্ব হাতধোয়া দিবস’ বা ‘গ্লোবাল হ্যান্ডওয়াশিং ডে’ হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। বিশ্বের ৭০টি দেশের প্রায় ১২ কোটিরও বেশি শিশু সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার মাধ্যমে এই দিনটি উদযাপন করা শুরু করেছিল। তবে হাত ধোয়ার এই যুগান্তকারী ধারণাটি সর্বপ্রথম নিয়ে আসেন ভিয়েনার বিশিষ্ট চিকিৎসক ড. ইগনাল সেমেলউইজ।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বাসাবাড়ি, হাসপাতালসহ নানা স্বাস্থ্যকেন্দ্র, স্কুল ও অন্যান্য জনপরিসরে হাত ধোয়ার অভ্যাস জরুরি। আগামী মহামারি থেকে বাঁচতে হলে হাত অবশ্যই ধোয়ার প্রবণতা বাড়াতে হবে। তবে জেএমপি’র প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে— স্বাস্থ্যকেন্দ্রে হাত ধোয়ার অভ্যাসের চিত্র আশানুরূপ নয়। প্রতিবেদনে দেখা গেছে, দেশের ৮১ শতাংশ হাসপাতালে মানসম্পন্ন স্যানিটেশন, ৬৬ শতাংশ হাসপাতালে হাত ধোয়া বা জীবাণুমুক্ত করার ব্যবস্থা নেই। ৬৩ শতাংশ হাসপাতাল প্রয়োজনীয় বর্জ্য ব্যবস্থাপনা করছে না, এমনকি ২১ শতাংশ হাসপাতালে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের যথাযথ ব্যবস্থা নেই।
প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, হাত জীবাণুমুক্ত করার মৌলিক ব্যবস্থা আছে দেশের ৩৪ শতাংশ হাসপাতালে। এই সুযোগ সীমিত আকারে আছে ৬৩ শতাংশ হাসপাতালে। আবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও হাত ধোয়ার ব্যবস্থা অপ্রতুল। জেএমপির ২০২০ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের ৯৯ ভাগ স্কুলে হাত ধোয়ার সুবিধা আছে। তবে মাত্র ৪৮ শতাংশ স্কুলে পানি ও সাবান পাওয়া যায়। অর্থাৎ প্রতিটি ক্ষেত্রেই কিছু না কিছু ঘাটতি থেকেই যাচ্ছে।
জাতীয় হাইজিন সার্ভে-২০১৮ অনুযায়ী, বাংলাদেশে জনসংখ্যার পাঁচ শতাংশ মানুষের জন্য হাত ধোয়ার কোনও ব্যবস্থা নেই। ৩৩ শতাংশ লোকের সীমিত ব্যবস্থা রয়েছে। বাকিদের হাত ধোয়ার জ্ঞান থাকলেও তা প্রতিপালনে সবার মাঝে অনীহা রয়েছে।
বাংলাদেশে ২০১২-২০১৩ সালে সাবান ও পানি দিয়ে হাত ধোয়ার অভ্যাস থাকা মানুষের সংখ্যা ছিল ৫৯ দশমিক ১ শতাংশ। ২০১৯ সালে এর পরিমাণ দাঁড়ায় ৭৪ দশমিক ৮ শতাংশ এবং তবে বর্তমানে তা কমে ২৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।
২০১৮ সালের তথ্য বলছে, ৫৫ শতাংশ উত্তরদাতা জানিয়েছে, টয়লেটের পর সাবান দিয়ে হাত ধুতে হয়, ৪০ শতাংশ বলেছেন খাওয়ার আগে, ৩৬ শতাংশ বলেছেন খাবার তৈরির আগে, ১৫ শতাংশ বলেছেন শিশুদের খাওয়ানোর আগে এবং ৯ শতাংশ বলেছেন শিশুকে শৌচ করানোর আগে হাত ধোয়ার কথা। অর্থাৎ হাত ধোয়ার সাধারণ জ্ঞান তাদের আছে।
শিক্ষার্থীদের মধ্যে হাত ধোয়ার বিষয়ে বেশি উত্তরদাতা বলেছে, খাবারের আগে ও টয়লেট করার পর। খাবার তৈরির আগে ও শিশুকে খাওয়ানোর আগে— এমন উত্তরদাতা ছিল সবচেয়ে কম। সমীক্ষার তথ্য আরও বলছে, খাবার তৈরির আগে হাত ধুয়েছে এমন রেস্তোরাঁ কর্মচারীর সংখ্যা খুব কম। ওই সমীক্ষায় বলা হয়, বাংলাদেশে প্রায় ৬০ শতাংশ মানুষ খাবারের আগে হাত ধোয় না।
ইউনিসেফের এক জরিপে দেখা গেছে, সারা বিশ্বে বছরে প্রায় ১ দশমিক ৪ বিলিয়ন শিশু বা প্রতি চার জনে একজন শিশু ডায়রিয়া এবং নিউমোনিয়ায় মারা যায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, নিয়মিত হাত ধোয়ার অভ্যাস বছরে প্রায় ১০ লাখ ডায়রিয়াজনিত মৃত্যু এবং প্রায় ১৬ শতাংশ শ্বাস-প্রশ্বাসের সংক্রমণজনিত রোগের ঝুঁকি কমাতে পারে। তবে শুধু পানি দিয়ে হাত পরিষ্কার করলে তাতে জীবাণু সংক্রমণের আশঙ্কা থেকে যায়। সেক্ষেত্রে ক্ষারযুক্ত সাবান, তরল সাবান বা অ্যালকোহলযুক্ত হ্যান্ড স্যানিটাইজার এসব ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া বা জীবাণু ধ্বংসের জন্য অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা পালন করে। বস্তুত সাবান দিয়ে হাত পরিষ্কার করার অভ্যাস যেকোনও মহামারি বা রোগের প্রাদুর্ভাব রোধ, কিংবা নিয়ন্ত্রণে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে পারে।
ওয়াটারএইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর হাসিন জাহান বলেন, ‘করোনার সময়ে হাত ধোয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। হাত ধুলে ৮০ ধরনের রোগ থেকে মানুষ রক্ষা পেতে পারে। এছাড়া আমরা যদি পরবর্তী মহামারির কথা চিন্তা করি, যেটি ধারণা করা হচ্ছে — অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স। অর্থাৎ আমাদের শরীরে অ্যান্টিবায়োটিক কাজ করবে না। ওষুধ হিসেবে আমরা এটি যেমন গ্রহণ করি, আবার বিভিন্ন খাবারের মাধ্যমে আমাদের শরীরে অ্যান্টিবায়োটিক প্রবেশ করছে। সুতরাং, ওষুধ সরাসরি গ্রহণ না করলেও আমাদের শরীর তা অন্যভাবে গ্রহণ করছে। আমাদের শরীর থেকে যখন মলমূত্রের মাধ্যমে বের হচ্ছে, তখন তা পরিবেশে চলে যাচ্ছে, পানিতে মিশে যাচ্ছে, খাদ্যচক্রে কোনও না কোনোভাবে প্রবেশ করছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘প্রান্তিক পর্যায়ে চিকিৎসকরা একের পর এক রোগী দেখছেন। কিন্তু তাদের জন্য সেখানে হাত ধোয়ার তেমন কোনও ব্যবস্থা নেই। চিকিৎসক বা নার্স একজন রোগীকে দেখার পর, আরেকজনকে দেখেন। তখন তার হাত থেকেও জীবাণু ছড়াচ্ছে। সুতরাং, এই যে হাত ধোয়ার একটা প্র্যাকটিস, এটি সব জায়গায় হওয়া দরকার।’
হাসিন জাহানের মতে, হাত না ধোয়ার পেছনে তিনটি কারণ রয়েছে— এক. উপযুক্ত সুযোগ সুবিধা নেই। দুই. হাত ধোয়া সামাজিক রীতি হিসেবে গড়ে তোলা যাচ্ছে না। তিন. হাত ধোয়ার প্রয়োজনীয়তা আমরা ধারণ করছি না। এর জন্য প্রয়োজন সচেতনতা। সামাজিক রীতি হিসেবে গড়ে তোলার জন্য ছোটবেলা থেকেই শিশুকে সেই চর্চা করাতে হবে।
গবেষকদের মতে, স্বাস্থ্যবিধির নানা রকম প্রাথমিক জ্ঞানের মধ্যে সঠিকভাবে হাত ধোয়া অন্যতম। হাত ধোয়া দৈনন্দিন জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সুস্থতার জন্য সাবান দিয়ে হাত ধোয়া খুবই জরুরি। নানা কারণে হাত নোংরা হয়ে প্রতিদিন হাজারো জীবাণু মানবদেহে সংক্রমিত হয়। অবচেতনভাবে প্রতিনিয়ত আমরা হাত দিয়ে ক্রমাগত চোখ, নাক ও মুখ স্পর্শ করে থাকি। হাত অপরিষ্কার থাকলে— এমন স্পর্শের মাধ্যমে দেহের ভেতরে জীবাণু প্রবেশ করতে পারে। বিশেষ করে খাবার গ্রহণের আগে এবং টয়লেট ব্যবহারের পর হাত ধোয়ার প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। শুধু পানি দিয়ে হাত ধুলেই যে জীবাণুমুক্ত হয়, তা নয়। সঠিক নিয়মে সাবান দিয়ে হাত না ধুলে নানারকম ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক ও অন্যান্য জীবাণু হাতের মাধ্যমে খাদ্যের সঙ্গে আমাদের দেহে প্রবেশ করে। যার ফলস্বরূপ ডায়রিয়া, কলেরা, ইনফ্লুয়েঞ্জা এমনকি কোভিড-১৯ রোগের মতো নানাবিধ সংক্রামক রোগ হতে পারে। আর এসব রোগ থেকে বাঁচতে সঠিকভাবে হাত ধোয়ার সু-অভ্যাস গড়ে তোলা প্রয়োজন।
যুক্তরাষ্ট্রের সিডিসি’র তথ্য অনুযায়ী, খাবার তৈরির আগে, সময়ে, এবং পরে, খাবার খাওয়ার আগে এবং পরে, বমি বা ডায়রিয়ায় আক্রান্ত এমন কাউকে বাড়িতে সেবা করার আগে ও পরে, একটি কাটা বা ক্ষত চিকিৎসার আগে ও পরে, টয়লেট ব্যবহারের পরে, টয়লেট ব্যবহারকারী শিশুর ডায়াপার পরিবর্তন বা পরিষ্কার করে দেওয়ার পরে, নাক ঝাড়া, কাঁশি বা হাঁচির পরে, একটি প্রাণী, প্রাণীর খাবার, বা প্রাণিজ বর্জ্য স্পর্শ করার পরে, পোষা প্রাণীর খাবার বা পেট ট্রিটস নাড়াচাড়ার পরে, আবর্জনা স্পর্শ করার পরে হাত ধোয়া জরুরি।
সঠিক উপায়ে হাত ধোয়ার ৫টি ধাপ
১. পরিষ্কার, প্রবহমান জল (গরম বা ঠান্ডা) দিয়ে আপনার হাত ভেজান, কল বন্ধ করুন এবং সাবান ব্যবহার করুন। ২. সাবান দিয়ে ঘষে আপনার হাতে সাবানের ফেনা তৈরি করুন। আপনার হাতের পৃষ্ঠদেশ, আঙুলের মাঝে এবং নখের নিচে ফেনা সৃষ্টি করুন। ৩. অন্তত ২০ সেকেন্ডের জন্য আপনার হাত ঘষুন। ২০ সেকেন্ড সময় বুঝতে হাত ধোয়ার সময় ‘হ্যাপি বার্থডে’ গানটি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দুই বার গুনগুন করুন। ৪. পরিষ্কার, প্রবাহমান জল দিয়ে আপনার হাত ভালোভাবে ধুয়ে নিন এবং ৫. একটি পরিষ্কার তোয়ালে দিয়ে বা বাতাসে আপনার হাত শুকিয়ে নিন।
প্রিভেন্টিভ মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, ‘হাত দিয়ে আমরা খাবার খাই। সেখানে হাতে লেগে থাকা ময়লা আমাদের মুখ দিয়ে শরীরে প্রবেশ করে। হাতে লেগে থাকা ময়লা চোখ, ত্বক ও নাক দিয়ে শরীরে প্রবেশ করে। এ কারণে হাত ধোয়া আমাদের জন্য জরুরি। বিশেষ করে যে দেশের মানুষ মল ত্যাগের পরে শৌচ কাজে হাত ব্যবহার করে, সেখানে মলের সঙ্গে থাকা জীবাণু হাতে ও চোখে চলে আসতে পারে। যেসব দেশে ধুলাদূষণ অত্যন্ত বেশি, সেখানে যেকোনও জায়গা থেকেই হাতে ময়লা চলে আসতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে, হাত ধোয়ার কারণে নিউমোনিয়া রোগীর সংখ্যা ৬০ ভাগ কমানো গিয়েছিল। তাই হাত ধোয়া অত্যন্ত জরুরি।’