ডায়াবেটিস এক ধরনের মেটাবলিক ডিজঅর্ডার। শরীরে ইনসুলিন হরমোনের অভাবে এ রোগ হয়ে থাকে। মানুষের শরীরে অগ্নাশ্যয় থেকে তৈরি হরমোন ইনসুলিন কোন কারণে কাজ না করলে বা পর্যাপ্ত তৈরি না হলে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা বা ব্লাড সুগার বৃদ্ধি পায়। আর এই অবস্থাকেই ডায়াবেটিস বলা হয়ে থাকে।
ডায়াবেটিস চোখ, কিডনি, স্নায়ু এবং হার্টের ক্ষতির ঝুঁকি বাড়ায়। এ ছাড়া ডায়াবেটিস কিছু ধরনের ক্যান্সারের সাথেও যুক্ত।
ডায়াবেটিসের প্রকার
সাধারণত ডায়াবেটিস চার প্রকার
১. টাইপ ১ ডায়াবেটিস
মানুষের শরীর যখন খুব কম বা কোন ইনসুলিন তৈরি করে না তখন তাকে টাইপ ১ ডায়াবেটিস বলা হয়। এই ধরনের ডায়াবেটিস সাধারণত শিশু এবং অল্প বয়স্কদের হয়ে থাকে। সুস্থ থাকতে টাইপ ১ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের প্রতিদিন ইনসুলিন নিতে হয়।
২. টাইপ ২ ডায়াবেটিস
মানুষের শরীরে ইনসুলিন তৈরি হলেও যখন ইনসুলিন সঠিকভাবে কাজ করে না তখন তাকে টাইপ ২ ডায়াবেটিস বলা হয়।
৩. গ্যাস্টেশনাল ডায়াবেটিস
সাধারণত গর্ভকালীন সময়ে যে ডায়াবেটিস হয়ে থাকে তাকে গ্যাস্টেশনাল ডায়াবেটিস বলা হয়ে থাকে। তবে বেশিরভাগ সময়, এই ধরনের ডায়াবেটিস শিশুর জন্মের পরে চলে যায়।
৪. প্রিডায়াবেটিস
প্রিডায়াবেটিসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি থাকলেও টাইপ ২ ডায়াবেটিসের তুলনায় কম থাকে। অর্থাৎ মাঝামাঝি একটা অবস্থানে থাকে। প্রিডায়াবেটিসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের ভবিষ্যতে টাইপ ২ ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে।
ডায়াবেটিস হলে কি খাবেন
একটি স্বাস্থ্যকর, সুষম খাদ্যাভাস ডায়াবেটিসের ঝুঁকি অনেকাংশে কমিয়ে আনতে পারে। ডায়াবেটিস হলে কি কি খাওয়া উচিত তা দেয়া হল,
১. হোল গ্রেইনস এবং ফাইবারযুক্ত খাবার
হোল গ্রেইনস বা পুরো শস্য থেকে শরীর সমস্ত কার্বোহাইড্রেট শোষণ করে না বিধায় রক্তে শর্করার মাত্রা বৃদ্ধির সম্ভাবনা কম। এ ছাড়া ফাইবার একটি স্বাস্থ্যকর কার্বোহাইড্রেট যার ফলে এটা শরীরে ভেঙে গ্লুকোজ তৈরি হয় না বা অতিরিক্ত ক্যালোরি তৈরি করেনা। বাদামী চাল, বার্লি, কুইনোয়া বা কাউনের চাল, ওটমিল ইত্যাদি উচ্চ ফাইবারযুক্ত খাবার যা ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখে।
২. ফল এবং শাকসবজি
কিছু কিছু ফল এবং শাক-সবজিতে উচ্চ মানের কার্বোহাইড্রেট এবং ফাইবার থাকে, যেমন ব্রকলি, গাজর, টমেটো, আলু, ভুট্টা, শিম, মটরশুটি এবং মসুর ডাল। এই খাবারগুলি গ্লুকোজের শোষণকে ধীর করতে সাহায্য করে এবং এরা ভিটামিন, খনিজ এবং ফাইবারের দুর্দান্ত উৎস।
যদিও ফলে উচ্চ পরিমাণে শর্করা থাকতে পারে, তবে কিছু কিছু ফল ডায়াবেটিস আক্রান্তরা খেতে পারবেন। যেমন, আপেল, অ্যাভোকাডো, বেরি, চেরি, জাম্বুরা, পীচ, নাশপাতি, বরই, স্ট্রবেরি ইত্যাদিতে কম গ্লাইসেমিক থাকায় শর্করা বেশি উৎপন্ন হয়না।
৩. স্বাস্থ্যকর প্রোটিন
প্রোটিন শরীরকে তার টিস্যু তৈরি, বজায় রাখতে এবং প্রতিস্থাপন করতে সহায়তা করে। আমাদের অঙ্গ, পেশী এবং ইমিউন সিস্টেম প্রোটিন নিয়ে গঠিত। তবে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের প্রাণীজ প্রোটিনের মধ্যে মুরগি, চর্বি ছাড়া গরুর মাংস, লাল মাংস, মাছ বিশেষ করে ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড সমৃদ্ধ, ডিম ইত্যাদি খাওয়া উচিত।
এছাড়া উদ্ভিজ্জ প্রোটিনের মধ্যে মটরশুটি, মসুর ডাল, বাদাম, সয়া সস ইত্যাদি খেতে পারেন ডায়াবেটিসে আক্রান্তরা। এ ছাড়া দুগ্ধজাত পণ্যের মধ্যে মিষ্টি ছাড়া দই, কম চর্বিযুক্ত পনির, দুধ ইত্যাদি খাওয়া যেতে পারে।
৪. স্বাস্থ্যকর ফ্যাটি এসিড
আমেরিকান ডায়াবেটিস অ্যাসোসিয়েশন ডায়াবেটিস আক্রান্তদের মনোস্যাচুরেটেড এবং পলিআনস্যাচুরেটেড ফ্যাট বা স্বাস্থ্যকর চর্বি খাওয়ার পরামর্শ দেয়। কারণ এগুলো খারাপ কোলেস্টেরলের মাত্রা কমিয়ে হৃদরোগ এবং স্ট্রোকের ঝুঁকিও কমায়।
বিভিন্ন ধরনের বাদাম, আখরোট, বাদামের তৈরি তেল বা মাখন, জলপাই তেল, অ্যাভোকাডো, সূর্যমুখীর তেল, সামুদ্রিক মাছ, চিয়া সিড, টোফু, ডিম ইতাদিতে মনোস্যাচুরেটেড এবং পলিআনস্যাচুরেটেড ফ্যাট পাওয়া যায়। এগুলো ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে খুবই উপকারি।
৫. পানীয় বা ফলের জুস
ডায়াবেটিস বা এর ঝুঁকি আছে এমন ব্যক্তিদের জন্য কম শর্করাযুক্ত পানীয় খাওয়া উচিত। মিষ্টি ছাড়া চা, কফি এবং জিরো-ক্যালোরিযুক্ত পানীয় খেতে পারেন তারা। এ ছাড়া শুধু পানি খেতে না চাইলে পানির সাথে নানা ধরনের ফলের অংশ মিশিয়ে নিতে পারেন। যেমন লেবুর শরবত।
ডায়াবেটিস হলে যা খাবেন না
১. প্রক্রিয়াজাত মাংস – যেমন বেকন, হ্যাম বা গরুর মাংসে অনেক ক্ষতিকারক রাসায়নিক থাকে। এগুলো ক্যান্সার এবং হৃদরোগের মতো রোগের সাথেও যুক্ত। এগুলো শরীরে ডায়াবেটিস বৃদ্ধি ও অন্যান্য সমস্যা তৈরি করে থাকে।
২. সম্পূর্ণ চর্বিযুক্ত দুগ্ধজাত পণ্যগুলিতে প্রাথমিকভাবে স্যাচুরেটেড ফ্যাট বা খারাপ চর্বি থাকে যা হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়। পাশাপাশি উচ্চ চর্বিযুক্ত খাবারে বেশি ক্যালোরি থাকে, তাই এসব পণ্য স্থূলতার ঝুঁকি বাড়ায়।
৩. অতিরিক্ত শর্করাযুক্ত খাবারে বেশিরভাগই চিনি এবং নিম্নমানের কার্বোহাইড্রেট থাকে যা রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ বাড়িয়ে তোলে। ফলে ওজন বৃদ্ধি এবং হৃদরোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকিও থাকে। কেক, প্যাস্ট্রি, কুকিজ, চকলেট ইত্যাদি ডায়াবেটিস আক্রান্তদের এড়িয়ে চলা উচিত।
৪. শুকনো ফল ক্ষুধা মেটানোর একটি সুস্বাদু উপায় এবং এতে ভালো পরিমাণে ফাইবার থাকে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, এগুলো চিনি দিয়ে ভরা থাকে বিধায় ডায়াবেটিস আক্রান্তদের না খাওয়াই ভালো। শুকনো ফলের পরিবর্তে তাজা ফল খাওয়ার চেষ্টা করা উচিত।
৫. অতিরিক্ত ভাজাপোড়া বা ফাস্টফুড খাবার এড়িয়ে চলতে হবে। এগুলোতে থাকা অস্বাস্থ্যকর চর্বি কোলেস্টেরলের মাত্রা বাড়াতে পারে এবং ইনসুলিন তৈরি করতে বাঁধা দেয়। মাখিন, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই, আলুর চিপস, বাসী খাবার, বার্গার ইত্যাদি খাবার রক্তে শর্করার বৃদ্ধি করে থাকে।
৬. অ্যালকোহলযুক্ত পানীয়গুলিতে চিনি এবং কার্বোহাইড্রেটও থাকে। তাই ডায়াবেটিস আক্রান্তদের অ্যালকোহলযুক্ত পানীয়ের ব্যবহার সীমিত করা উচিত।
সূত্র: মেডিকেল নিউজ টুডে এবং ডায়াবেটিস কেয়ার কমিউনিটি