নারী অঙ্গ নিয়ে ট্যাবু স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে ফেলে নারীকেই

0
46
নারী অঙ্গ নিয়ে ট্যাবু
ছবি: সংগৃহীত

নিজের শরীর ও যৌনাঙ্গের স্বাস্থ্য সমস্যা নিয়ে খোলামেলা আলাপ করা সহজ হচ্ছে না বলে পরে নারীকেই ভুগতে হচ্ছে। নারী অঙ্গের নাম বলতে বিব্রত হওয়ার প্রবণতায় দিন শেষে নারীস্বাস্থ্যই বিপদের মুখে পড়ছে বলে সতর্ক করেছেন ব্রিটিশ চিকিৎসকরা।

যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসের জেনারেল ফিজিশিয়ান আজিজা সিসে বলেন, ”নারী শরীর নিয়ে অতি যৌনতাকেন্দ্রিক যে দৃষ্টিভঙ্গি, সেখান থেকেই কুসংস্কার, অজ্ঞতা ও লজ্জা স্থায়ী রূপ পায়।”

আর তাতে করে জরুরি স্বাস্থ্যসেবা থেকেও নারী বঞ্চিত হয় বলে মনে করছেন এ চিকিৎসক।

বিবিসি লিখেছে, আরও একটি উদ্বেগের বিষয় হল, যে শিশুদের সবসময় সুন্দর ভাষা ব্যবহার করতে শেখানো হয়েছে, কখনও নির্যাতনের শিকার হলেও সেই ভাষার কারণে যথাযথভাবে ঘটনা প্রকাশ হয় না, ফলে বিষয়টি যথযাথ গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয় না।

যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসের জেনারেল ফিজিশিয়ান সিসে সোশাল মিডিয়া কনটেন্ট বানানোর কাজ করেন। তিনি মূলত নারীকে সচেতন করার বার্তা দেন। একই সঙ্গে তিনি ভাষাগত বাধা ভেঙে ফেলার চেষ্টা করছেন।

কিন্তু এই কাজেও অনেক বাধার মুখে পড়তে হয় বলে জানালেন আজিজা সিসে।

তিনি বলেন, ”আমাকে সেন্সরশিপের মুখে পড়তে হয়েছিল। যখনই আপনি ক্যাপশনে স্পষ্ট করে ভালভা, ভ্যাজাইনা, ক্লিটোরাস বলবেন, এরপরই আপনার কনটেন্টের এনগেজমেন্ট কমে যাওয়া নিয়ে প্রস্তুত থাকতে হবে। কারণ অ্যালগোরিদম স্বয়ংক্রিয়ভাবে ধরে নেয়, এখানে কিছু একটা উল্টোপাল্টা আছে অথবা পর্নগ্রাফিক কিছু আছে।”

এমনকি নারীদেহের রেখাচিত্র প্রকাশ করতে গেলেও অনলাইনে ‘স্পর্শকাতর’ লেবেল লাগিয়ে দেওয়া হয়; মানুষকে দেখার আগে সতর্ক করে বলা হয়, এই ছবি ‘বিব্রতকর’ হতে পারে।
সিসে বলেন, “তোমার নারী অঙ্গ – তোমার ভালভা, তোমার ভ্যাজাইনা, তোমার ক্লিটোরাস, তোমার ল্যাবিয়া, তোমার ইনার ল্যাবিয়া, তোমার আউটার ল্যাবিয়া – এসব কোনো কিছুই লজ্জাজনক নয়।

“এসর তোমার শারীরিক গঠনেরও অংশ। ঠিক যেমন তোমার মাথা, ঘাড় এবং পায়ের তালু।”

তিনি বলেন, অনেক নারীর বেলায় স্বাস্থ্য সমস্যা প্রায়ই গুরুতর নয় বলে ধরে নেওয়া হয়; এর অর্থ মৃত্যুর সম্ভাবনা রয়েছে এমন অসুস্থতা এটা নয়।

আর এখানেই সিসের আপত্তি। তার ভাষ্য, অসুস্থতা নারীর জীবনে কীরকম বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে, ওই ধরনের আচরণের মাধ্যমে তা থেকে মনোযোগ সরিয়ে রাখা হয়।

মহামারীর সময় ‘গুরুতর নয়’– এমন অসুখে স্বাস্থ্যসেবা প্রাধান্য পায়নি। এসব রোগীকে দীর্ঘদিন অপেক্ষা করতে হয়েছে চিকিৎসা করাতে।

যদিও ২০২২ সালের গ্রীষ্ম থেকে পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। এরপরও আট হাজার নারী এক বছরের বেশি সময় ধরে অপেক্ষা করছেন ওয়েলসে একজন স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞের সাক্ষাত পাওয়ার জন্য।

এদিকে এরমধ্যে স্বাস্থ্যসেবা ফিও কিছুটা বেড়েছে বলেও জানাচ্ছে বিবিসি।
আরও অনেক নারীস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের সঙ্গে আগামী ২৪ জুন কার্ডিফের এভরিউইমেন ফেস্টিভালে অংশ নিচ্ছেন সিসে। ওই সম্মেলনে মাসিক থেকে মেনোপজ পর্যন্ত বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হবে।

এ সম্মেলনে আরও থাকবেন ন্যাশনাল হেথল সার্ভিসের যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য এবং মেনোপজ পরামর্শক মাইকেল ওলভার।

দক্ষিণ-পূর্ব ওয়েলসে এনেউরিন বেভান স্বাস্থ্য বোর্ডের এই কর্মকর্তা বলেন, “শুধু যে রোগী নিজে এ ধরনের শব্দচয়নে কুণ্ঠাবোধ করছেন তা নয়।

“পেরি-মেনোপজ ও মেনোপজের উপসর্গ হচ্ছে নারীর যোনিতে শুষ্কতা, চুলকানি, যৌনতায় অনীহা; আর এসবই এক সূত্রে বাঁধা। যাদের যোনিপথে ব্যথা হয় তারা যৌনসম্পর্ক এড়িয়ে চলতে চায়। কিন্তু বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, যৌনসম্পর্ক নিয়ে এবং যোনির ঠিক কোথায় ব্যথা অনুভব হচ্ছে তা আলাপ করা স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের পক্ষে খুব সহজ হয়ে উঠছে না।

”ছবি দিয়ে বোঝালে অবশ্য রোগীর জন্য খুব সুবিধা হয়। আমরা স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরাই যদি যৌনসম্পর্ক নিয়ে কথা বলতে এতসব অস্বস্তির মধ্যে দিয়ে যাই, তাহলে একজন নারীর পক্ষে নিজে থেকে এসব অসুবিধার কথা খোলামেলা বলা আরও কঠিন।”
জুলি কর্নিশ প্রস্তাবিত সম্মেলনে মাসিক থেকে মেনোপজ পর্যন্ত বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হবে। ছবি: বিবিসি
জুলি কর্নিশের চিন্তার ফসল হল ‘কার্ডিফস এভরিউইমেন ফেস্টিভাল’। তিনি কাজ করছেন কার্ডিফ অ্যান্ড ভ্যালে স্বাস্থ্য সম্পর্কিত বোর্ডে।

জুলি কর্নিশ বলেন, “বিব্রতকর লক্ষণগুলো নিয়ে খুব একটা আলাপ হয় না। রোগী এসব উপসর্গ নিয়ে ১০ থেকে ১৫ বছর মুখ বুজে কাটিয়ে দিয়েছে– এমন চিত্রও বিরল নয়। তারা এমন এক স্তরে পৌঁছে যায়, যেখানে সম্পর্কও হয়ত নড়বড়ে হয়ে যায়।

“যারা আগেভাগে অবসর নেয়, তারা কাজ ও সামাজিকতা বন্ধ করে দেয়। আর এই দূরে থাকা মানে পরিস্থিতি আরও সাংঘাতিক। গোড়ায় নজর দিলে সাধারণ ফিজিওথেরাপি, খাদ্যাভ্যাস বদলে সুস্থ হওয়া সম্ভব হত। কিন্তু দেরি হওয়ার কারণে হয়ত অস্ত্রোপচার করা জরুরি হয়ে ওঠে।”

না বলা কথা বলার জন্যই এই সম্মেলন করার তাগিদ অনুভব করেছেন জুলি কর্নিশ ।

তিনি বলেন, “আমার মনে হয়, সমাজের কিছু কিছু ক্ষেত্রে ক্ষমতা ও কথা বলার ইচ্ছাশক্তি রয়েছে, তারা বলতে চায়– ‘আমি এসবে মোটেও সুখি নই, আমার সাহায্য দরকার’।

”আবার নিশ্চয় এমন গোষ্ঠীও আছে, যেখানে এগুলো বড় বিষয় ও বাধা হিসেবে কাজ করে। আমি এসব বিষয় নিয়ে কথা বলতে ভীষণ আগ্রহী। এগুলো আমাদের মেয়েদের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ।”

তিনি বলেন, ”আগামীতে আমি চাই, ওরা এমন একটি পৃথিবীতে বাঁচুক, যেখানে কথা বলা যায়। যেখানে তারা স্বাস্থ্যসেবা পাবে এবং তাদের কাউকে মানহীন জীবন মেনে নিতে হবে না।”