রাজধানীর ভেতরে সাধারণ মানুষের জন্য নিবেদিত স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী এমন একটি হাসপাতাল সম্পর্কে জানা নেই অনেকেরই। অবকাঠামোগত উন্নয়ন, বরাদ্ধ বৃদ্ধি এবং জনবল বাড়ানো সম্ভব হলে স্বাস্থ্যসেবা বঞ্চিত সাধারণ মানুষের অন্যতম আশ্রয়স্থল হতে পারে রাজধানীর আগারগাঁয়ের এই প্রবীণ হাসপাতাল। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলে জানা যায়, সঠিক প্রচারণার অভাবে ইচ্ছে থাকা সত্বেও সেবা নিতে পারছেন না অনেকেই। তাছাড়া বেশকিছু সীমাবদ্ধতা থাকায় বৃহৎ পরিসরে প্রচারনাও চালাতে পারছে না প্রতিষ্ঠানটি।
প্রবীণদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে গড়ে উঠা প্রবীণ হাসপাতাল সম্পর্কে জানা যায়, মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এ কে এম আবদুল ওয়াহেদ রাজধানীর ধানমন্ডিতে তাঁর বাসভবনে ১৯৬০ সালে একটি বাইগাম গড়ে তুলেছিলেন। এমন একটি মহতী উদ্যোগের সাথে জড়িত ছিলেন জাতীয় অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ ইব্রাহিম, ডক্টর কুদরত ই ক্ষুদার মত মানবসেবায় নিবেদিতরা । সময়ের পরিক্রমায় এক সময় সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিচালিত প্রতিষ্ঠানটি ১৯৮০ সালে রাজধানীর আগারগাঁয়ে স্থায়ীভাবে জায়গা বরাদ্ধ পায়। শুরুতে ২০ শয্যা দিয়ে শুরু হলেও বর্তমানে ৫০ শয্যায় উন্নীত হয়েছে প্রবীণ হাসপাতাল। প্রতিষ্ঠার পর থেকে বিভিন্ন সময়ে সরকারী-বেসরকারীভাবে প্রাপ্ত আর্থিক সহায়তায় নির্মিত চারতলা ভবনটিতে চলছে হাসপাতালটির সার্বিক চিকিৎসা সেবা কার্যক্রম।
চিকিৎসা সেবা প্রসঙ্গে প্রবীণ হাসপাতালের পরিচালক আবু আলতাফ হোসেন জানান, জাতীয় প্রবীণ নীতিমালা অনুযায়ী ৬০ বছর বা তার বেশি বয়েসী ব্যক্তিরাই প্রবীণ। জাতিসংঘের জনসংখ্যা বিষয়ক সংস্থা ইউএনএফপিএর হিসেবে বলা হয়েছে, ২০২৫ সাল নাগাদ বাংলাদেশে প্রবীণদের সংখ্যা প্রায় দুই কোটি ছাড়িয়ে যাবে।
আর ২০৫০ সালের মধ্যে দেশে প্রবীণদের সংখ্যা অপ্রাপ্তবয়স্ক এবং তরুণদেরও ছাড়িয়ে যাবে বলে মন্তব্য করেন তিনি। সেই প্রেক্ষাপট বিবেচনা করেই প্রবীণদের সেবা দানের লক্ষ্যে কাজ করছে প্রবীণ হাসপাতাল।
পরিচালক আবু আলতাফ হোসেন বলেন, অনেকেই হাসপাতালটির নাম দেখে মনে করে এটি শুধুমাত্র প্রবীণদের জন্য। কিন্তু এটা মূলত একটা জেনারেল হাসপাতাল। সব বয়সের মানুষের এখানে চিকিৎসা নেয়ার সুযোগ রয়েছে। প্রচারণার অভাবে অনেকের মাঝে এই ধারণা জন্মেছে বলে জানান তিনি।
সরকারী ও বেসরকারীভাবে প্রাপ্ত অর্থ থেকে প্রতিষ্ঠানটির ব্যয়ভার পরিচালনার পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন স্থানে স্থাপিত শাখাগুলোতেও অর্র্থ প্রদান করে থাকে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
বর্তমানে মেডিসিন, জেরিয়েট্রিক মেডিসিন, কার্ডিওলজি, ইএনটি, সার্জারি, ফিজিওথেরাপি, অর্থোপেডিকস, ডায়াবেটিক, গাইনি, চর্ম, ডেন্টাল বিভাগে কনসালটেন্টসহ মেডিকেল অফিসাররা নিয়মিত সেবা প্রদান করছেন। তবে অর্থের অভাবে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের ব্যবস্থা করতে পারছে না কর্তৃপক্ষ।
হাসপাতালের বহির্বিভাগে সকাল আটটা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত মাত্র ৩০ টাকার বিনিময়ে প্রাথমিক সেবা নিতে পারছেন প্রবীণ রোগীরা। এছাড়া অন্যান্য বয়েসীদের জন্য নির্ধারিত ফি ৫০ টাকা।
তবে গরিব রোগীদের অনেকটা বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা দেয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। কিডনি রোগীদের জন্য মাত্র আড়াই হাজার টাকায় ডায়ালাইসিসের ব্যবস্থা করেছে প্রতিষ্ঠানটি। স্বল্পমূল্যে রোগী ভর্তি, ব্যবস্থাপত্র প্রদান, বেশকিছু প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হলেও অর্থ সংকটের কারণে এমআরআই, সিটিস্ক্যানসহ গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি কেনা যাচ্ছে না বলে জানালেন প্রবীণ হাসপাতালের পরিচালক আবু আলতাফ হোসেন।
৫০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালটিতে সাধারণ বেডের দৈনিক চার্জ মাত্র ২০০ টাকা। নন এসি কেবিনের ভাড়া এক হাজার টাকা। এছাড়া এসি কেবিন ভাড়া পাওয়া যায় মাত্র দেড় হাজার টাকায়। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য রয়েছে দুটি ফ্রি বেডের ব্যবস্থা।
রোগীদের আনা নেয়াসহ সার্বক্ষনিক সেবা প্রদানের জন্য রয়েছে দুটি অ্যাম্বুলেন্স। ৫০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালটিতে দুটি পুরুষ ওয়ার্ড এবং দুটি মহিলা ওয়ার্ড রয়েছে। হাসপাতালটি প্রবীণদের জন্য নিবেদিত হলেও নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রের সংকট রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক আবু আলতাফ হোসেন বলেন, সরকারের আর্থিক সহায়তা বৃদ্ধিসহ সঠিক প্রচারণা পেলে চিকিৎসা সেবার মান বৃদ্ধির পাশাপাশি সব বয়েসী রোগীদের চিকিৎসা প্রদানে কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে সক্ষম হবে প্রতিষ্ঠানটি।
বাংলাদেশ প্রবীণ হিতৈষী সংঘ ও জরাবিজ্ঞান প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অনুমোদনে ২০১০ সাল থেকে ইনস্টিটিউট অব জেরিয়াট্রিক মেডিসিন (আইজিএম) নামে চিকিৎসাবিষয়ক একটি শিক্ষা কার্যক্রম চালু রয়েছে। এ কার্যক্রমের অংশ হিসেবে বর্তমানে চার বছর মেয়াদি ডিপ্লোমা কোর্স চালু রয়েছে হাসপাতালটিতে।ডিপ্লোমা কোর্সের পাঠ্যসূচিতে পর্যায়ক্রমে বার্ধক্য ও প্রবীণকল্যাণ বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্তির প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। ইনস্টিটিউট অব জেরিয়াট্রিক মেডিসিন (আইজিএম) প্রফেশনাল প্রশিক্ষণের আওতায় প্যাথলজি, ফিজিওথেরাপি ও নার্সিংয়ে ডিপ্লোমা কোর্স পরিচালিত হচ্ছে। এ ছাড়া বিদেশে কর্মসংস্থান তৈরিতে জেরিয়াট্রিক কেয়ার গিভিং সার্ভিস কোর্সেও প্রশিক্ষণ চলছে।
বর্তমানে স্থপতিরাও ভবন নির্মাণে প্রবীণদের বিষয়টি মাথায় রাখছেন বলে এখানে এসে প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। এ বিষয়গুলো ভবিষ্যতে প্রবীণবান্ধব বাংলাদেশ গড়তে সহায়ক ভূমিকা রাখবে বলে আশা প্রকাশ করেন হাসপাতালটির পরিচালক আবু আলতাফ হোসেন।