ছোটবেলায় দেখেছি গ্রামের প্রতিবেশী এক চাচার হাত সারা দিন কাঁপত। বসে থাকলে কাঁপুনি আরো বেশি হতো। বেচারা কাঁপুনির জন্য ঠিকমতো খেতেও পারতেন না। খুব মায়া লাগত। তাঁকে কতবার জিজ্ঞেস করেছি চিকিৎসা করেন না কেন? তিনি নিয়তি বলেই মেনে নিয়েছিলেন। কিছুদিন কবিরাজের ওষুধ খেয়েছিলেন, কিন্তু কোনো উন্নতি হয়নি। গরিব মানুষটির কপালে চিকিৎসা জোটেনি।
সচরাচর চলতে গেলেই এক ধরনের লোকের দেখা পাওয়া যায়, যাঁদের হাত অনবরত কাঁপতে থাকে। এ ধরনের ব্যক্তিরাই পারকিনসনস রোগে আক্রান্ত। এটি বেশ পুরনো রোগ। ১৮১৭ সালে জেমস পারকিনসন ছয় ব্যক্তির এ রোগ সম্পর্কে বর্ণনা দেন। তাঁর নামানুসারে এ রোগের নাম রাখা হয়েছে।
যুক্তরাজ্যের প্রতি ৫০০ জনে একজন এ রোগে আক্রান্ত হয়। আমাদের দেশে এমন কোনো পরিসংখ্যান না থাকলেও এ রোগে আক্রান্তের সংখ্যা কিন্তু কম নয়। অনেকে মনে করেন, এ রোগ ভালো হয় না বা এ রোগের কোনো চিকিৎসা নেই। তাই তাঁরা নিয়তি বলে মেনে নিয়ে কষ্টকর জীবন যাপন করতে থাকেন। কিন্তু এটি পুরোপুরি সত্য নয়। এ রোগের চিকিৎসা আছে। এ রোগ ওষুধে পুরোপুরি নির্মূল করা যায় না সত্য, তবে ওষুধ সেবনের মাধ্যমে এ রোগ নিয়ন্ত্রণে রেখে স্বাভাবিক জীবন যাপন করা সম্ভব।
কেন হয়?
আমাদের শরীরে বিভিন্ন কেমিক্যাল থাকে। এগুলো একটা নির্দিষ্ট পরিমাপে থাকে। এসিটাইলকোলিন ও ডোপামিন এমনই দুটি কেমিক্যাল। এগুলো দেহে সমপরিমাণে থাকে। এগুলোর ভারসাম্য নষ্ট হলে শরীরে নানা প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়।
মানুষের মস্তিষ্কে খুব ছোট একটা অংশ আছে, যাকে বলে ‘সাবস্টেনশিয়া নিগ্রা’। ছোট এ অঙ্গে ডোপামিনে ভরপুর স্নায়ু থাকে। বয়স বেড়ে যাওয়ার কারণে সাবস্টেনশিয়া নিগ্রা ক্ষয়ে যায়। ফলে কমে যেতে থাকে ডোপামিনে ভরপুর কোষ। এ কারণে মস্তিষ্কে ডোপামিন কমে যায়। এতে এসিটাইলকোলিন ও ডোপামিনের ভারসাম্য আর থাকে না। আর এ ভারসাম্যহীনতাতেই দেখা দেয় পারকিনসনস ডিজিজ। বেশির ভাগ পারকিনসনস ডিজিজ এভাবেই হয়ে থাকে। আবার কম বয়সীদের এ রোগ সাধারণত বংশগত কারণে হয়ে থাকে।
কিন্তু কেন এই রোগটি হয় তার কারণ এখনও অজানা। তবে মনে করা হয়, জেনিটিক মিউটেশন বা রূপান্তরের পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের টক্সিন ও ভাইরাসের সংক্রমণে এ রোগের লক্ষণ পরিলক্ষিত হয়। সাধারণত বেশি বয়সীরা এ রোগে আক্রান্ত হন। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এ রোগে আক্রান্তের হার বাড়ে। বংশে কারো এ রোগ থাকলে আক্রান্তের হার চার থেকে ছয় গুণ বাড়ে। এ ছাড়া যাঁরা আগাছা ও পোকামাকড় দমনের ওষুধ ছিটানোর কাজে জড়িত, তাঁদের মধ্যে এ রোগের হার বেশি বলে গবেষণায় জানা গেছে।
লক্ষণ
বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সাধারণত হাতের কাঁপুনির মাধ্যমে এ রোগ লক্ষণ দেখা দেয়। ধীরে ধীরে তা বাড়তে থাকে। কোনো কাজের সময় কাঁপুনি বেশি হয়। তবে বিশ্রামকালীনও কাঁপুনি এ রোগের অন্যতম লক্ষণ। হাঁটাচলা করতেও সমস্যা দেখা দেয়। হাঁটা শুরু করতে দেরি হয়। সামনের দিকে ঝুঁকে ছোট ছোট পায়ে হাঁটতে হয়। হঠাৎ করে ঘুরতে গেলে পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। কোনো কাজ শুরু করতে দেরি হয়। মাংসপেশি শক্ত হয়ে যায়। এ রোগে আক্রান্তদের চেহারা দেখে মনে হবে তাঁদের কোনো ইমোশন নেই। গলার স্বর ভারী ভারী ও মনোটোনাস হয়। কথায় জড়তা ভর করে। হাঁটার সময় হাত শরীরের সঙ্গে লেগে থাকে। বিষণ্নতায় বেশি ভোগেন। রাতে ঘুমের ঘোরে হাত-পা ছোড়াছুড়ি করা, ঘুমে ব্যাঘাত, কোষ্ঠকাঠিন্য হওয়া, নাকের ঘ্রাণ কমে যাওয়ার সমস্যা দেখা দিতে পারে।
রোগ নির্ণয়
এ রোগ নির্ণয় করতে পারে এমন কোনো পরীক্ষা নেই। চিকিৎসকরা রোগের ইতিহাস শুনে এবং শারীরিক পরীক্ষা করে এ রোগ সম্পর্কে নিশ্চিত হন। এ রোগের মতো অন্যান্য রোগকে আলাদা করতে ব্রেনের এমআরআই পরীক্ষার প্রয়োজন হতে পারে। তবে কম বয়সীদের আরো কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষার দরকার হতে পারে।
চিকিৎসা
এ রোগের চিকিৎসা দীর্ঘমেয়াদি। উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিসের মতো আজীবন এ রোগের চিকিৎসা করতে হয়। অনেকে কিছুদিন চিকিৎসা করে ওষুধ সেবন বন্ধ করে দেন। ফলে তাঁরা সুস্থ হন না। এ রোগকে নিয়তি বলে মেনে নেন। তাঁদের জন্য বলছি, এ রোগ চিকিৎসায় নিয়ন্ত্রণ করা যায়। চিকিৎসার মাধ্যমে এ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা স্বাভাবিক কাজকর্ম করতে পারেন।
এ রোগের চিকিৎসায় অনেক ওষুধ আছে। চিকিৎসকরা ওষুধ অল্প ডোজে শুরু করে ধীরে ধীরে ডোজের পরিমাণ বাড়াতে থাকেন। একটি নির্দিষ্ট ডোজের ওষুধে বেশ উন্নতি দেখা দেয়। লেভোডোপা ও কার্বিডোপা সেবনে লক্ষণগুলো অনেকাংশে কমে যায়। এখন পর্যন্ত এটি এ রোগ চিকিৎসার সেরা ওষুধ। এ ছাড়া রেসেজেলিন, প্রামিপেক্সল, সেলেজিলিন, এমানটিডিন, অ্যান্টিকলিনার্জিক ওষুধ ব্যবহার করা হয়।
এ ছাড়া সার্জারি করা যায়। একে বলে ‘ডিপ ব্রেন স্টিমুলেশন’ বা ‘ডিবিএস’। তবে আমাদের দেশে খুব কম হয়। ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস হাসপাতালে খুব অল্প রোগীর করা হয়েছে। এ রোগ পুরোপুরি ভালো হয় না। তাই এ রোগে আক্রান্তদের ওষুধ সেবনের পাশাপাশি লাইফস্টাইল পরিবর্তন করা জরুরি।
এ রোগে আক্রান্তদের পুষ্টিকর সুষম খাবার খেতে হবে। প্রতিদিনের খাবারে শাক-সবজি, ফলমূল থাকতে হবে। আক্রান্তদের কোষ্ঠকাঠিন্য দেখা যায়। এ জন্য ফাইবারসমৃদ্ধ খাবার বেশি করে খাওয়ার পাশাপাশি প্রচুর পরিমাণে পানি পান করতে হবে। আক্রান্তরা হাঁটতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে পড়ে গিয়ে আহত হন। আবার বয়স বেশি বলে পড়া থেকে ভেঙে যায় হাড়।
এটি প্রতিরোধ করতে হলে সচেতন হতে হবে। হাঁটার সময় তাড়াহুড়া করবেন না। কেউ ডাকলে হঠাৎ করে না ঘুরে আস্তে আস্তে ইউ টার্ন নিন। হাঁটার সময় কোনো কিছু বহন করবেন না। এমন পোশাক পরুন, যেটিতে বোতাম কম বা চেইন আছে। এ রোগ কিভাবে প্রতিরোধ করা যায়, তা নিয়ে অনেক গবেষণা হলেও ভালো ফল পাওয়া যায়নি। তবে গবেষকরা বলেছেন, কফিজাতীয় তরল পানে এর ঝুঁকি কমে।
লেখক: ডা. হুমায়ুন কবীর হিমু, নিউরোলজিস্ট
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস, ঢাকা