বাংলাদেশে প্রতি বছর জুন-জুলাই থেকে অক্টোবর-নভেম্বর পর্যন্ত ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে ডেঙ্গু জ্বর। এবারও ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা দেওয়ার আশংকা আছে। আর এজন্যই দরকার জনসচেতনতা।
ডেঙ্গু জ্বরে শিশুরাই বেশিরভাগ আক্রান্ত হয়। এটি এডিস মশাবাহিত রোগ। এ মশা ঘরের আশপাশে জমানো পানিতে জন্মায় এবং সাধারণত দিনের বেলা কামড়ায়। সময়মতো সঠিক চিকিৎসাব্যবস্থা নিলে ডেঙ্গু জ্বরে শিশুর ক্ষতি হয় না বা মৃত্যুও ঘটে না।
এ রোগের সংক্রমণের চারটি পর্যায় আছে
* প্রথমটিতে জ্বর হয়, যা অন্যান্য ভাইরাল জ্বর থেকে আলাদা করা প্রাথমিকভাবে কঠিন।
* দ্বিতীয় পর্যায়ে নাক, মুখ ও খাদ্যনালিতে রক্তক্ষরণ দেখা দিতে পারে।
* তৃতীয় পর্যায়ে রক্তক্ষরণের পাশাপাশি রক্তরস (প্লাজমা) লিকেজ হয় বা শিরা-উপশিরা দিয়ে রক্তরস বেরিয়ে যায়। এ কারণে প্লাটিলেট ও শ্বেত রক্তকণিকা কমে যায়, বাড়ে হিমাক্রিট/হিমোগ্লোবিন। এর প্রভাবে অনেকে শক-এ চলে যান অর্থাৎ হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যায়, শিরার গতি বেড়ে যায়, রক্তচাপ কমে যায়। এটাকে বলে ‘ডেঙ্গি শক সিনড্রোম’।
* চতুর্থ ও ভয়াবহ পর্যায় হলো ‘এক্সপান্ডেড ডেঙ্গি সিনড্রোম’। এ পর্যায়ে লিভার, কিডনি, মস্তিষ্ক ও হৃৎপিণ্ডে সমস্যা দেখা দেয়।
কীভাবে বুঝবেন শিশুর ডেঙ্গু জ্বর হয়েছে-
জ্বরের লক্ষণ অনুসারে এ জ্বরকে তিনটি পর্যায়ে ভাগ করা হয়।
* প্রথম পর্যায় : তিন থেকে পাঁচ দিন পর্যন্ত জ্বর স্থায়ী হতে পারে।
লক্ষণগুলো হলো-
* তীব্র জ্বর (১০৩ ডিগ্রি থেকে ১০৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট)।
* তীব্র মাথাব্যথা, বিশেষ করে কপালের দিকে।
* চোখের পেছনে ব্যথা, যা চোখের মণি ঘুরালে বাড়ে।
* পুরো শরীর ব্যথা এবং গিঁটে ব্যথা।
* বমিভাব বা বমি করা।
দ্বিতীয় পর্যায় : এ সময়ে জ্বর কমে যায়, কিন্তু রক্তক্ষরণ বা অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার আশংকা থাকে। যা দু’তিন দিন পর্যন্ত থাকতে পারে। কখনো কখনো শুধু হাতের তালু, পায়ের তালু বা শরীরের ত্বকের নিচে লাল হয়ে যায় এবং চুলকায়।
শরীরের ভেতর রক্তক্ষরণ হওয়া বা অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার লক্ষণগুলো হলো-
* তীব্র এবং একটানা পেট ব্যথা।
* নাক-মুখ, দাঁতের মাড়ি বা ত্বকের নিচে রক্তক্ষরণ।
* বারবার বমি এবং সঙ্গে রক্ত যাওয়া।
* আলকাতরার মতো পায়খানা।
* খুব বেশি পিপাসা পাওয়া বা জিহ্বা শুকিয়ে যাওয়া।
* প্রস্রাব কমে যাওয়া।
* জ্বরের সঙ্গে শরীরে লাল লাল দাগ দেখা যাওয়া।
* চোখের সাদা অংশে রক্ত জমাট বেঁধে যাওয়া।
* শরীর ঠান্ডা বা ফ্যাকাসে হয়ে যাওয়া।
* অতিরিক্ত ঘাম হওয়া।
বিশেষ লক্ষণগুলো হলো-
* ঘুম ঘুম ভাব।
* একটানা কান্না।
* শ্বাসকষ্ট।
এসব লক্ষণের যে কোনো একটি দেখা গেলেই শিশুকে দ্রুত ডাক্তার দেখান বা হাসপাতালে নিয়ে যান।
* তৃতীয় পর্যায় : অল্প ক’দিনের মধ্যে শিশু ভালো হয়ে যায়। যদিও শরীরে দুর্বল ভাবটা থেকেই যায় তারপরেও রোগী খেতে পারে, চলাফেরা করতে পারে। সব মিলিয়ে পুরো অসুস্থতার সময়টা ৭ থেকে ১০ দিন পর্যন্ত থাকতে পারে।
প্রাথমিক চিকিৎসা ও পরিচর্যা
* শরীরের তাপমাত্রা ১০১ ডিগ্রি ফারেনহাইটের নিচে রাখতে চেষ্টা করুন। বারবার কুসুম গরম পানিতে কাপড় ভিজিয়ে শরীর মুছে দিন।
* জ্বর কমানোর জন্য শুধু প্যারাসিটামল ব্যবহার করুন (দিনে চার বারের বেশি নয়)। আইবুপ্রুফেন, এসপিরিন, ডাইক্লোফেন জাতীয় ওষুধ ব্যবহার করবেন না। এগুলো রক্তক্ষরণ বাড়িয়ে দেয়।
* শিশুকে বেশি করে পানি বা পানি জাতীয় খাবার দিন, যেমন-খাবার স্যালাইন, ডাব, স্যুপ, দুধ, ফলের রস এবং এসবের সঙ্গে অন্যান্য খাবার দিন।
* বারবার বমি হলে হাসপাতালে নিয়ে যান।
* রক্তক্ষরণজনিত কোনো সমস্যা দেখা দিলে সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে নিন।
ডেঙ্গু রোগ মশার কামড়ে ছড়ায়। তাই, এগুলো সাধারণত বর্ষাকালে হয় যা মশার বেঁচে থাকা এবং প্রজনন উভয়কেই সাহায্য করে। অন্য সব জ্বরের বিপরীতে যেখানে জ্বরের সময় বিপদ, ডেঙ্গুর বিপদের সময় জ্বর কমে যাওয়ার সময়। বমি, পেট ব্যথা, অস্থিরতা বা অলসতা এবং যে কোনো স্থান থেকে রক্তপাতের মতো সতর্কতা চিহ্নসহ ডেঙ্গিতে আক্রান্ত শিশুদের নিবিড় পর্যবেক্ষণের জন্য ভর্তির প্রয়োজন।
* ব্যক্তিগত নিরাপত্তা
ঘুমের সময় বিছানায় মশারি ব্যবহার করতে হবে। শিশুকে হালকা রঙের ফুলহাতা জামা ও ফুলপ্যান্ট পরাতে হবে, যাতে হাত ও পা পুরোপুরি ঢেকে যায়। স্কুলের ইউনিফর্মও যাতে পুরো হাত ও পা ঢেকে যায়। পা পুরোপুরি ঢেকে রাখতে মোজা এবং জুতা পরাতে হবে।
মশা নির্মূল
* বাসায় নিয়মিত মশা নিরোধক প্রয়োগ করতে হবে। মশার স্প্রে ব্যবহার করুন। সম্ভাব্য স্থান যেখানে মশা থাকে যেমন-আসবাবপত্রের নিচে, পর্দার আড়ালে এবং বাইরের জায়গা যেমন গ্যারেজ, ঝোপঝাড়, বিছানা এবং বাড়ির চারপাশে পুরু গাছপালা।
* স্কুলের জানালা ও দরজায় পর্দা লাগান।
* স্যাঁতসেঁতে এবং অন্ধকার জায়গা তৈরি করা এড়িয়ে চলুন যেখানে মশা থাকে।
* নিয়মিতভাবে ছুটির সময় শ্রেণিকক্ষ, খেলার মাঠ এবং স্কুলের চারপাশে ফগিং করুন। মশার কার্যকলাপ সবচেয়ে বেশি হলে সন্ধ্যা বা ভোরের দিকে করা হলে সবচেয়ে ভালো হয়।
মশা নিয়ন্ত্রণ
* বাগান পরিস্কার-পরিছন্ন ও পরিপাটি রাখতে হবে এবং ঝোপঝাড় যতটা সম্ভব ছোট করে ছাঁটাই করে দিতে হবে। যদিও এটি প্রজনন ক্ষেত্র নয় তবে এটি প্রাপ্তবয়স্ক মশার জন্য সম্ভাব্য লুকানোর জায়গা হিসাবে কাজ করে যা ভবিষ্যতের প্রজননকারী।
* গাছের টবে, বালতি, পুরোনো টায়ার কিম্বা কোনো পাত্রে পানি জমিয়ে রাখা যাবে না।
* টিন, পাত্র এবং টায়ারের মতো জল ধারণ করতে পারে এমন সব আবর্জনা সরাতে হবে যা মশার প্রজনন ক্ষেত্র।
* কৃত্রিম পুকুর বা জলাশয় নির্মাণ করবেন না। যদি আগে থেকে পুকুর বা জলাশয় তৈরি থাকে তবে তাতে লার্ভিসাইডাল এজেন্ট বা লার্ভিসাইডাল মাছ ব্যবহার করুন।
* আটকে থাকা বৃষ্টির নালা ও ড্রেনগুলো পরিষ্কার করুন।
জটিলতা
ডেঙ্গি জ্বর সাধারণত চতুর্থ দিনের মধ্যেই কমে যায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই জ্বরের পরই অনেকে সুস্থ হয়ে যান। পঞ্চম থেকে সপ্তম দিন পর্যন্ত সংকটকালীন পর্যায়। তখন প্লাজমা লিকেজ শুরু হয় এবং পরবর্তী জটিলতাগুলো ধারাবাহিকভাবে দেখা দেয়। তখন রক্তক্ষরণ বা শক হতে পারে।
আবার ব্যতিক্রমও হয়। জ্বর কমার আগেই অর্থাৎ ৩ থেকে ৪ দিনের মধ্যে ব্লাড প্রেশার কমে, পেটে ও বুকে পানি চলে আসে। এক্ষেত্রে রোগী শক-এ চলে যায়, রক্তক্ষরণ শুরু হয়।
ডেঙ্গু জ্বরে গুরুতর অসুস্থতা খুবই মারাত্মক। বাংলাদেশে ডেঙ্গুর যে চারটি ধরন শনাক্ত হয়েছে, তার মধ্যে মারাত্মক ক্ষতিকর ধরনটি ‘ডেনভি ৩’-এ অধিকাংশ মানুষ ২০১৯ সালে আক্রান্ত হয়েছিল। ২০২১ সালেও ডেঙ্গির এ ধরনের দাপট দেখা গিয়েছিল।
* জটিলতার সম্ভাব্য কারণ
সম্ভাব্য কারণ হলো, ডেঙ্গু ভাইরাসের চারটি ধরনের পার্থক্য, তা ছাড়া কেউ দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হলে তার জটিলতা বেশি হয়। এ ছাড়া ভাইরাসটির বিরুদ্ধে শরীরের রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থা ও প্রতিক্রিয়ার কারণেও জটিলতা বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা থাকে।
মনে রাখবেন
* জ্বর হলে জ্বর কমাতে শুধু প্যারাসিটামল খাওয়াতে হবে।
* কুসুম গরম পানি দিয়ে শরীরে স্পঞ্জ করতে হবে।
* পর্যাপ্ত পানি, স্যালাইন ও তরল পান করাতে হবে।
* জটিলতা এড়াতে শিগ্গির চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
* ঘুমের সময় মশারি ব্যবহার করতে হবে।
* বাড়ির পরিষ্কার-পরিছন্নতার দিকে খেয়াল রাখতে হবে। বিশেষ করে কোথাও যেন পানি না জমে থাকে।