বর্তমান সময়ে কর্মব্যস্ততা, অস্বাস্থ্যকর খাবার ও জীবনযাপন আর মানসিক চাপের কারণে বেশীরভাগ মানুষই আক্রান্ত হচ্ছে হাইপারটেন্শন বা উচ্চ রক্তচাপ রোগে। এক সময় ধরে নেয়া হত কেবল বয়স্ক মানুষ অর্থাৎ ৪০ বছরের বেশি হলেই কারও উচ্চ রক্তচাপের আশঙ্কা তৈরি হয়। কিন্তু বর্তমান সময়ে নানাবিধ কারণে কম বয়সেও নারী থেকে পুরুষ সবাই আক্রান্ত হচ্ছেন উচ্চ রক্তচাপে।
হাইপারটেনশন বা উচ্চ রক্তচাপ কী?
রক্তচাপ বা ব্লাড প্রেশার হলো মানুষের শরীরের ধমনির প্রবাহ। হৃৎপিণ্ড থেকে রক্ত যখন শরীরের বিভিন্ন অংশে প্রবাহিত হয়, তখন ধমনির দেয়ালে চাপ প্রয়োগ করে এবং এ চাপই রক্তচাপ নামে পরিচিত।
সাধারণত একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের (১৮ বছরের ঊর্ধ্বে) রক্তচাপ যদি ১৩০/৮৫ মি.মি. পারদের নিচে থাকে তাহলে এটিকে স্বাভাবিক রক্তচাপ বলা হয় | আর যদি রক্তচাপ ১৪০/৯০ বা এর বেশি হলে একে উচ্চ রক্তচাপ বলে |
হাইপারটেনশন কত প্রকার
হাইপারটেনশন বা উচ্চ রক্তচাপ সাধারণত দুই প্রকার। প্রাইমারি হাইপারটেনশন এবং সেকেন্ডারি হাইপারটেনশন।
প্রাইমারি হাইপারটেনশন
বেশীরভাগ বয়স্ক মানুষের মধ্যে কোন কারণ ছাড়াই যে হাইপারটেনশন দেখা যায় তাকে প্রাইমারি হাইপারটেনশন বলে। এটি অনেক বছর ধরে ধীরে ধীরে বিকাশ করতে থাকে। অ্যাথেরোস্ক্লেরোসিস নামক ধমনিতে প্লাক জমা হওয়ার কারণে এ ধরনে উচ্চ রক্তচাপ হয়।
সেকেন্ডারি হাইপারটেনশন
এই ধরনের উচ্চ রক্তচাপ কোন না কোন অবস্থার কারণে হয়। এটি হঠাৎ দেখা দেয় এবং প্রাথমিক উচ্চ রক্তচাপের তুলনায় বেশি রক্তচাপ সৃষ্টি করে। সাধারণত কোন রোগ বা কোন ওষুধ থেকে এই ধরনের উচ্চ রক্তচাপ হয়ে থাকে।
হাইপারটেনশনের লক্ষণ
হাইপারটেনশনের বা উচ্চ রক্তচাপের বেশিরভাগ মানুষেরই কোনো উপসর্গ থাকে না, এমনকি রক্তচাপ বিপজ্জনকভাবে উচ্চ মাত্রায় পৌঁছালেও অনেক ক্ষেত্রে তেমন কোন লক্ষণ দেখা যায় না। তবে মাঝে মাঝে যেসব লক্ষণ দেখা দিতে পারে তা হল,
মাথাব্যথা
নিঃশ্বাসের দুর্বলতা
নাক দিয়ে রক্ত পড়া
অতিরিক্ত ঘাম
মানসিক চাপ বা উদ্বেগ
ঘুমের সমস্যা ইত্যাদি।
হাইপারটেনশন কেন হয়
উচ্চ রক্তচাপের কারণ প্রায়ই জানা যায় না। অনেক ক্ষেত্রে, এটি শরীরের ভেতরের শারীরিক কোন অবস্থার ফলাফল হতে পারে।
প্রাথমিক হাইপারটেনশনের কারণ
প্রাথমিক উচ্চ রক্তচাপ হওয়ার যেসব কারণ ধরা হয়ে থাকে তা হল,
স্থূলতা
ইনসুলিন রেজিসট্যান্স
বেশি লবণ গ্রহণ
অত্যধিক অ্যালকোহল গ্রহণ
অস্বাস্থ্যকর জীবনধারা
ধূমপান
সেকেন্ডারি হাইপারটেনশনের কারণ
অন্যদিকে সেকেন্ডারি হাইপারটেনশনের নির্দিষ্ট কিছু কারণ রয়েছে এবং সাধারণত অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যার জটিলতা হিসেবে সেকেন্ডারি হাইপারটেনশন হয়ে থাকে।
দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগ
ডায়াবেটিস
জন্মগত (জন্ম থেকে বর্তমান) হার্টের ত্রুটি।
থাইরয়েড রোগ।
নির্দিষ্ট কিছু ওষুধের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া।
ফিওক্রোমোসাইটোমা – অ্যাড্রিনাল গ্রন্থির একটি বিরল ক্যান্সার
এন্ডোক্রাইন (হরমোন-সম্পর্কিত) টিউমার।
অ্যাড্রিনাল গ্রন্থির ব্যাধি (উভয় কিডনির উপরে অবস্থিত গ্রন্থি)
গর্ভাবস্থা
নিদ্রাহীনতা
হাইপারটেনশনের প্রতিরোধ-প্রতিকার ও চিকিৎসা
১. হাইপারটেনশন বা উচ্চ রক্তচাপের জন্য আদর্শ এবং প্রথম সারির চিকিৎসা হল জীবন-যাত্রার পরিবর্তন। স্বাস্থ্যকর খাবারের পাশাপাশি রুটিন-মাফিক জীবন যাপন অনেকাংশে উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখে।
২. হাইপারটেনশনের রোগীদের নিয়মিত হাঁটা, জগিং, সাইকেল চালানো, সাঁতারের মত ব্যায়াম করা উচিত।
৩. মানসিক চাপ কমানো বা এড়িয়ে চলা একজন ব্যক্তিকে উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করতে পারে।
৪. অতিরিক্ত লবণ, অ্যালকোহল এবং চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ খাওয়া এড়ানো উচিত, কারণ এগুলি উচ্চ রক্তচাপ এবং উচ্চ রক্তচাপযুক্ত জটিলতায় বৃদ্ধি করে তোলে।
৫. ধূমপানও রক্তচাপ বাড়াতে পারে। তাই উচ্চ রক্তচাপ, গুরুতর হৃদরোগ এবং অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যার ঝুঁকি কমাতে ধূমপান ত্যাগ করাই শ্রেয়।
৬. যাদের উচ্চ রক্তচাপ আছে বা হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে তাদের চর্বিযুক্ত খাবার বা স্যাচুরেটেড ফ্যাট খাওয়া কমাতে হবে। এসবের পরিবর্তে উচ্চ ফাইবারযুক্ত খাবার, বিভিন্ন ফল এবং সবজি, শস্য জাতীয় খাবার, বাদাম ইত্যাদি খাওয়া উচিত
৭. কিছু কিছু ক্ষেত্রে ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড, যেমন তৈলাক্ত মাছ এবং জলপাই তেল উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে হার্টের উপর প্রতিরক্ষামূলক প্রভাব ফেলে।
৮. অতিরিক্ত শরীরের ওজন উচ্চ রক্তচাপের অন্যতম কারণ হতে পারে। তাই উচ্চ রক্তচাপ এড়াতে শরীরের ওজন বডি মাস অনুযায়ী হতে হবে।
৯. হাইপারটেনশন বা উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে অবশ্যই চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে এবং চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের ওষুধ খেতে হবে।
সূত্র: মায়ো ক্লিনিক ও সিডিসি